পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকছে না মেডিকেল শিক্ষা

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকছে না মেডিকেল শিক্ষা

  • ক্যাম্পাস ডেস্ক

মেডিকেল শিক্ষার মানোন্নয়নে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ জন্য দেশে প্রচলিত মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর প্রস্তুতি চলছে। এরই অংশ হিসেবে মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের কার্যক্রম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণে না রেখে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আগামী শিক্ষাবর্ষেই নতুন এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে কাজ করে যাচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এ প্রসঙ্গে বলেন, বর্তমানে মেডিকেল শিক্ষাদানকারী কলেজগুলো চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং বিএমডিসির (বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল) মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। একাধিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের কারণে সমন্বয়ে যথেষ্ট ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এর ফলে মেডিকেল শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করা যাচ্ছে না। তাই মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলিত কাঠামো ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, সমন্বয় ও তদারক বাড়াতে মেডিকেল কলেজগুলোকে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কীভাবে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা যায় তা নির্ধারণ করতে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের মতামত পওয়ার পরই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানান মন্ত্রী।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মেডিকেল শিক্ষাকে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আনতে প্রস্তাবনা উপস্থাপনের লক্ষ্যে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। গত রোববার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে এক সভায় এ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান, বিএসএমএমইউর উপাচার্য, বিএমডিসি সভাপতি, বিএমএ সভাপতি এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (চিকিৎসা শিক্ষা) কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে এ সম্পর্কিত মতামত উপস্থাপন করতে বলা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এতদিন ধরে মেডিকেল শিক্ষা পরিচালিত হয়ে আসছিল। তবে কমিটিতে এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো প্রতিনিধি রাখা হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। এ নিয়ে ঢাবির কোনো আপত্তি নেই। তিনি বলেন, সম্প্রতি সাত সরকারি কলেজ অধিভুক্ত করা নিয়ে তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। আবারও সে ধরনের কোনো পরিস্থিতি হোক তেমনটি তিনি চান না। তাই মেডিকেল শিক্ষার মানোম্নয়নে সরকার যা ভালো মনে করবে, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমর্থন থাকবে।

যেভাবে চলছে মেডিকেল শিক্ষা কার্যক্রম: স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে দেশে বর্তমানে ৯৯টি মেডিকেল কলেজ, ১৫টি ডেন্টাল কলেজ ও ২১টি ডেন্টাল ইউনিট রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি মেডিকেল কলেজ ৩০টি। এ ছাড়া সরকারি ব্যবস্থাপনায় একটি ডেন্টাল কলেজ ও নয়টি ডেন্টাল ইউনিট রয়েছে। প্রচলিত কাঠামো অনুযায়ী বৃহত্তর ঢাকা ও বরিশাল বিভাগের মেডিকেল কলেজগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে। চট্টগ্রাম বিভাগের মেডিকেল কলেজগুলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) এবং সিলেট বিভাগের সব মেডিকেল কলেজ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) অধিভুক্ত। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) অধীনে পরিচালিত হচ্ছে রাজশাহী, খুলনা, রংপুর বিভাগ এবং যশোরের মেডিকেল কলেজগুলো। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনা কর্তৃপক্ষ হিসেবে মেডিকেল কলেজের সামগ্রিক শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। তবে সাভারের সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ এবং ইউএসটিসি (ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, চট্টগ্রাম) কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত নয়। এ ছাড়া দেশের পাঁচটি আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে স্থাপনা নির্মাণ ও পরিচালনার অনুমোদন নেওয়ার পর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করে অধিভুক্ত হওয়ার পর শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর অনুমোদন পায় মেডিকেল কলেজ। অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী নিবন্ধন, অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনা এবং সনদ প্রদান কার্যক্রম নিয়ন্ত্রিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন ফ্যাকাল্টির অধীনে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট ও সিনেট অনুমোদিত গভর্নিং কমিটির মাধ্যমে মেডিকেল কলেজ পরিচালিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিদর্শক দলের প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতি বছর আসন বাড়ানো-কমানো হয়ে থাকে। বেসরকারি কলেজের কার্যক্রম স্থগিত করার ক্ষমতাও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট ও সিনেট কমিটির হাতে ন্যস্ত। যদিও এমবিবিএস, বিডিএস কিংবা নার্সিং পাস করে সনদ পাওয়ার পর অস্থায়ী অনুমোদন পেতে বিএমডিসিতে আবেদন করতে হয় শিক্ষার্থীদের। এরপর ইন্টার্ন কোর্স সম্পম্ন করে আবারও আবেদন করে স্থায়ী নিবন্ধন নিতে হয় চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত হওয়ার জন্য।

যে কারণে পরিবর্তনের পদক্ষেপ: প্রচলিত কাঠামো অনুসারে মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক অনুমোদন দেওয়ার পর এ-সংক্রান্ত কার্যক্রমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিংবা অধিদপ্তরের আর কোনো ভূমিকা রাখার সুযোগ থাকে না। ফলে সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে বিভিন্ন সময় দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয়।

২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি পরীক্ষায় ন্যূনতম ৪০ নম্বর প্রাপ্তি বাধ্যতামূলক করা হলেও বেশিরভাগ পরীক্ষার্থী শর্ত পূরণে সফল না হওয়ায় বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের বেশিরভাগ আসন খালি থাকার আশঙ্কা তৈরি হয়। এমন প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ মালিক সমিতির পক্ষ থেকে শর্ত শিথিলের দাবি জানানো হয়। এর ভিত্তিতে ন্যূনতম হার কমিয়ে পাস নম্বর ৩০ নির্ধারণ করা হলে আরও অন্তত সাড়ে ৫০০ শিক্ষার্থী বেসরকারি ডেন্টাল কলেজে ভর্তির সুযোগ পান। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের অধিভুক্ত ডেন্টাল কলেজে এ নীতি বাস্তবায়নে আপত্তি তোলে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে কয়েক দফা বৈঠকের পর বাকিরা সম্মত হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাতে রাজি হয়নি। স্বাস্থ্যমন্ত্রী একাধিকবার ফোন করে ও চিঠি পাঠিয়ে পরিস্থিতি বিবেচনার অনুরোধ জানান ঢাবি উপাচার্যকে। তিনি বিষয়টি সিন্ডিকেট ও সিনেটের সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দেন। পরে মানবিক বিবেচনায় সিন্ডিকেট সভায় ভর্তির শর্ত শিথিলের বিষয়টি অনুমোদিত হয়। মূলত এ ঘটনার পরই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত না রেখে মেডিকেল কলেজগুলো মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালনার পরিকল্পনা গৃহীত হয়।

সূত্র: সমকালfavicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment