ঘুরে এলাম পূণ্যভূমি

ঘুরে এলাম পূণ্যভূমি

  • মো. নাজমুল হাছান

স্বপ্ন ছিল নবীজির দেশ মক্কা মদিনা ঘুরে আসবো কিন্তু এভাবে স্বপ্ন পূরণ হবে তা কখনও কল্পনাও করিনি। সৌদি আরব স্কাউট অ্যাসোসিয়েশনের অর্থায়নে বাংলাদেশ স্কাউটসের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে তৃতীয় আন্তর্জাতিক পিস ক্যাম্পে অংশগ্রহণের সুযোগ হয় আমার। ৬ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি রিয়াদে তৃতীয় আন্তর্জাতিক পিস ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হয়। এই ক্যাম্পে ৩৬ দেশের একজন করে প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করে। সৌদির রোভার স্কাউট, কর্মকর্তা ও স্বেচ্ছাসেবকসহ সাত শ জন এই ক্যাম্পে অংশগ্রহণ করে।

৫ ফেব্রুয়ারি রাতে শুরু হয় যাত্রা। প্রথবারের মতো ভিন্ন একটি দেশে নিজের দেশকে উপস্থাপন করবো বলে বুকের উত্তেজনাটা টের পাচ্ছিলাম। ৬ ফেব্রুয়ারি রিয়াদ কিং খালেদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌছাই। একই সময় অন্য ফ্লাইটে ইথিওপিয়ান রোভার বন্ধু ইয়োহানস মুলার বিমানবন্দরে এসে পৌছায়। সেখানে আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানান সৌদি অ্যারবিয়ান স্কাউটস অ্যাসোসিয়েশনের রোভারা। ছোট এক পরিচয়পর্বের পর আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় হোটেলে। হোটেলে গিয়ে দেখা হয় স্পেন ও মেক্সিকোর রোভার বন্ধুদের সাথে। হোটেলে সকালের নাস্তা করে আমরা কক্ষে যাই। বিকেলে ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে রিয়াদের কিং খালেদে রওনা দেই।

ক্যাম্পে প্রবেশ করে নিজ দেশের পতাকা উড়তে দেখে নিজকে অনেক গর্বিত মনে হলো। ক্যাম্পে পৌঁছানোর পর টের পাই, প্রচণ্ড শীত লাগছে। সবার মুখে সৌদি আরবের গল্প শুনলে বলতো গরমের কথা কিন্তু আমি গিয়ে পাই প্রচণ্ড শীত। তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি। অভ্যর্থনায় আরব সংস্কৃতির ঐতিহ্যগত অ্যারাবিক কফি ও খেজুর পরিবেশনা করে। ক্যাম্পের অভ্যর্থনা ও রেজিস্ট্রেশন শেষ করে ব্যাগ অ্যান্ড ব্যাগেজ তাঁবুতে রেখে চলে যাই ক্যাফেটেরিয়ায়। অন্য ক্যাম্পের চেয়ে এই ক্যাম্পের ক্যাফেটেরিয়া ছিল অন্য রকম বাহারি ডিজাইন ও বিভিন্ন খাবারের পরিবেশনা। সবার সাথে নিজ পছন্দ অনুযায়ী খাবার সংগ্রহ করে টেবিলে বসে খাবার সম্পূর্ণ করি।

ক্যাম্পের দিন শুরু হতো ফজরের নামাজ দিয়ে। সকাল বেলায় ঘুম ভাঙ্গানোর পদ্ধতি ছিল অন্যরকম। সৌদির রোভার বন্ধুরা সকাল বেলায় এসে ‘ইয়া আল্লাহ হাবিবি সালাত সালাত’ বলে মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকত। শুনতে অনেক ভালো লাগতো। নামাজ শেষ করে সবাই পরিদর্শনের জন্য প্রস্তুতি নিতাম। পরিদর্শন ও নাস্তা শেষে চলে যেতাম পিস প্রোগ্রামে। ক্যাম্পে চারটি পিস প্রোগ্রামে, এনভারমেন্টাল ফোরাম, ইন্টারন্যাশনাল ডে ও ভিন্ন স্থান পরিদর্শনের সুযোগ হয়। পিস প্রোগ্রামগুলো ছিল ডিসকভার ইউর ট্যালেন্ট, টেকনিক্যাল এন্ড প্রফশনাল স্কিলস, স্কাউট আর্ট, কমিউনিটি সার্ভিস।

পিস প্রোগ্রাম ‘ডিসকভার ইউর ট্যালেন্ট’- এ ইলেক্ট্রিক্যাল ও টেকনিক্যাল অ্যাপ্লিকেশনের সমন্বয়ে Fitness, Cam Scanner, My Measures, Duolingo, Snapased, Canva ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা আমাদের নিজেদের দক্ষতা যাচাই করি। অন্যতম পিস প্রোগ্রাম ‘টেকনিক্যাল এন্ড প্রফেশনাল স্কিলস’। এখানে আমরা মোবাইল ফোন, মোটরযান ও সোলার প্যানেল মেরামতের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। প্রশিক্ষণ শেষে নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনী চিন্তাধারা পেয়ে থাকি। পিস প্রোগ্রাম ‘স্কাউট আর্ট’। এখানে স্কাউটিং পদ্ধতিতে ওয়াগল, রিজ ব্যান্ড, ফ্রেন্ডশিপ নট তৈরি করা শিখি। সমাজের জন্য কিছু করতে পারার আনন্দ অনেক। সে আনন্দ উপভোগের সুযোগ হয় পিস প্রোগ্রামে। কমিউনিটি সার্ভিসের মাধ্যমে এখানে আমরা আমাদের ক্যাম্পের চারপাশ পরিষ্কার করি এবং গাছের চারা রোপন করি।

নিজ দেশের পরিবেশের কথা উপস্থাপন করার অন্যতম স্থান এনভারমেন্টাল ফোরাম। এ ফোরামে বাংলাদেশের পরিবেশের বিষয় উপস্থাপন করি এবং সৌদি আরবের পরিবেশের সাথে বাংলাদেশের পার্থক্য তুলে ধরি। এই ফোরামের মাধ্যমে উঠে আসে পরিবেশ ক্ষতির অন্যতম উপাদান প্লাস্টিক দ্রব্য। প্লাস্টিকের বিকল্প ব্যবহারের মাধ্যমে সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব তাই প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে এর বিকল্প দ্রব্য ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়।

ক্যাম্পে সবচেয়ে আনন্দদায়ক ও স্মরণীয় ইভেন্ট ছিল ইন্টারন্যাশনাল ডে। এখানে আনন্দের সাথে দেশীয় পোশাক পাঞ্জাবি, লুঙ্গি পড়ে দেশীয় পোশাক, ঐতিহ্যবাহী খাবার পিঠা পুলি ও মিষ্টির সাথে স্কাউট ব্যাজ, ওয়াগল, স্কার্ফ ও বই প্রদর্শন করি। এই সময় অন্য দেশের রোভার বন্ধুদের সাথে স্কাউট ব্যাজ, ওয়াগল ও স্কার্ফ বিনিময় করি।

কোন দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি জানতে হলে সে দেশের ঐতিহাসিক স্থানগুলো প্রদর্শন করতে হয়। তাই সৌদি আরবের ইতিহাস ও ঐতিহ্য জানার জন্য ক্যাম্পের অংশ হিসেবে আমি সাকর আল-জাজিরা এভিয়েশন মিউজিয়াম, কিং আব্দুল আজিজ হিস্টোরিকাল সেন্টার পরিদর্শন করি। সাকর আল-জাজিরা এভিয়েশন মিউজিয়াম সৌদির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের যৌথ সামরিক বাহিনীর ব্যবহৃত এভিয়েশনের সমন্বয়ে গঠিত। এখানে স্থান পেয়েছে সৌদি সরকারের জন্য ব্যবহৃত প্রথম যাত্রীবাহি বিমান। কিং আব্দুল আজিজ হিস্টোরিকাল সেন্টার প্রথমে সাংস্কৃতিক ও সভ্যতার কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বর্তমানে ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক জাদুঘর হিসাবে পরিচিত। এখানে আরব ইতিহাস ও ইসলাম  প্রচারের ঐতিহাসিক বিষয়গুলো স্থান পেয়েছে। Al Bujairi Heritage Park এ যেন সবুজের ছোঁয়া। বিশাল মরু ভূমিতে একটু সবুজের ছোঁয়া পেতে হাজারও মানুষ চলে আসে Al Bujairi Heritage পার্কে। এটি প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম ঘাস ও সৃজনশীলতার সমন্বয়ে গঠিত।

ক্যাম্প শেষ কনফারেন্সে যোগ দিতে চলে আসি হোটেলে, এখানে আসার পর জানতে পারি সবচেয়ে সুখের খবর, সৌদি আরব স্কাউট অ্যাসোসিয়েশনের অর্থায়নে পরেরদিন দুপুরে মক্কায় পাড়ি দিব পবিত্র ওমরা হজ পালনের জন্য। আমার সাথে মক্কার সহযাত্রী হলেন বসনিয়া ও নাইজারের রোভার বন্ধুরা। রাতের ডিনার শেষ করে আমরা মিটিংএ বসি সৌদি স্কাউট অ্যাসোসিয়েশনের আন্তর্জাতিক কমিশনার ড. আহমেদের সাথে। এ সময় তিনি আমাদেরকে ওমরার হজের বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করেন এবং রিয়াদ টু জেদ্দা প্লেনের টিকিট দেয়। একটু পরে সৌদির স্কাউটার রায়াত ফাহাদ এহরামের কাপড় নিয়ে আসে।

মিটিং শেষে ঘুমানোর জন্য রুমে যাই, ওমরা করব বলে মনের আনন্দে ছটপটে রাত অতিক্রম করি। পরের দিন ভোর পাঁচটায় ঘুম ভেঙ্গে যায়, ঘুম থেকে উঠে গোসল করে ফজরের সালাত আদায় করি। সকাল বেলা নাস্তা করে কনফারেন্সে যোগ দিয়েউদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে ফিরে আসি রুমে। মক্কা যাবার প্রস্তুতি নিয়ে হোটেলের লাউঞ্জে অপেক্ষা করি রাহাবার রায়াত ফাহাদের জন্য। অপেক্ষার প্রহর বেশি দীর্ঘায়িত হয়নি, একটু পরে তিন রোভার বন্ধু ও স্কাউটার রায়াত ফাহাদ সহ চার জনের টিমে চলে যাই রিয়াদ এয়ারপোর্টে। এয়ারপোর্টে বোর্ডিং পাস সম্পন্ন করে নামাজের স্থানে এহরামের কাপড় পরিধান করি। যোহরের নামাজ পড়ে লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক কন্ঠে যাত্রা শুরু করি। মাঝপথে রাহাবার রাহাত ফাহাদ ওমরা হজের নিয়ত করার জন্য বললে আমরা নিয়ত করি। একটু পরে পৌছালাম মক্কা নগরীতে। হোটেলে লাগেজ রেখে ছুটে চললাম কাবা ঘরের দিকে। ৫ মিনিট পর হাঁটতে মসজিদে হারাম এসে পৌছালাম মসজিদের ভিতরে ঢুকেই চোখের সামনে চলে আসলো কাবা ঘর। যে ঘরটি জন্মের পর থেকে টিভিতে দেখে আসছি আর আজ আমার সামনে। শরীর আমার কাঁপছে আর দোয়া করছি আল্লাহর দরবারে। একটু পরে আমাদের সাথে মক্কার দুই রোভার বন্ধু ও এক মোয়াল্লেম যোগ দেয়। মাগরিবের নামাজ শেষ করে মোয়াল্লেমের নির্দেশ অনুযায়ী কাবা ঘরের হাজরে আসওয়াদ বরাবর থেকে তওয়াফ শুরু করলাম। নিয়ম অনুযায়ী সাতবার তওয়াফের পর মাকামে ইব্রাহীমের পিছনে ওমরা হজের নিয়তে দুই রাকাত নামাজ পড়ি। এরপর জমজম পানি খেয়ে সাফা মারওয়া সাত চক্করদেই। মাথার চুল কাটানোর মধ্যে দিয়ে ওমরা হজের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করি।

এবার ছুটে চলি রিয়াদের পথে জেদ্দা এয়ারপোর্টে বসনিয়ার বন্ধুকে বিদায় জানাই তার দেশে পাড়ি জমাতে। অন্য যে সকল রোভার বন্ধুরা ওমরা করতে আসবে তাদের সহযোগিতা করার জন্য রাহবার রাহাত ফাহাদ মক্কায় থেকে যায়। আমি ও নাইজারের রোভার বন্ধু রিয়াদে চলে আসি। সকালে নাস্তা করে আবারো যোগদি কনফারেন্সে, লাঞ্চের সময়ে কনফারেন্স শেষ হয়। এরে মাধ্যমে সম্পূর্ণ হয় সৌদি আরবের সকল আনুষ্ঠানিকতা। বিকেলে কেনাকাটা শেষ করে ব্যাগ এন্ড ব্যাগেজ রেডি করে বাস্তব এবং জীবনমুখী শিক্ষা নিয়ে ১৫ দিনের স্বপ্নের এক ভ্রমণ শেষ করে ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে রওনা হই বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে। সুস্থভাবে ফিরে আসি নিজ জন্মভূমিতে।

 

লেখক: সিনিয়র রোভার মেট, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এয়ার রোভার স্কাউট গ্রুপ।
শিক্ষার্থী, বি.এস.সি. ইন ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।

Sharing is caring!

Leave a Comment