সম্ভাবনাময় রপ্তানি পণ্য ‘মুক্তা’

সম্ভাবনাময় রপ্তানি পণ্য ‘মুক্তা’

  • অর্থ ও বাণিজ্য ডেস্ক 

ঝিনুক থেকে পাওয়া যায় মহামূল্যবান বস্তু ‘মুক্তা’। বিশ্বব্যাপী অমূল্য রত্নরাজির ক্ষেত্রে হীরার পরই মুক্তার স্থান। যা প্রকৃতির এক অপার বিস্ময়। বাংলাদেশে প্রধানত প্রাকৃতিক উত্স হতে মুক্তা আহরণ হয়ে থাকে। এ মুক্তা আহরণের ইতিহাস দীর্ঘদিনের। আবহমানকাল হতে বিশেষ করে বেদে সম্প্রদায়ের মানুষ মিঠা পানির ঝিনুক হতে মুক্তা আহরণ করে আসছে। বাংলাদেশে রয়েছে বিস্তৃত এলাকা জুড়ে মিঠাপানির খাল, বিল, হাওর, পুকুর, দীঘি ও স্রোতহীন নদী। এসব জলাশয় মুক্তা বহনকারী ঝিনুকে পরিপূর্ণ। বাংলাদেশের জলবায়ুও মুক্তা চাষের জন্য উপযোগী। প্রাণিবিজ্ঞানের পরিভাষায় মোলাস্কা পর্বের (অখণ্ড দেহ ম্যান্টল দ্বারা আবৃত) কয়েকটি প্রাণীর দেহ নিঃসৃত পদার্থ জমাট বেঁধে যে পদার্থ সৃষ্টি হয় তাই মুক্তা নামে পরিচিত। আর এ সৃজন কর্মটি সম্পন্ন হয় ঝিনুকের দেহ অভ্যন্তরে। অনেকে মনে করেন, প্রাচীন আমল থেকে অর্থাত্ প্রায় এক হাজার চারশ’ বছর আগে থেকে চীনে মুক্তা চাষ শুরু হয় বলে জানা যায়। অন্য এক তথ্য থেকে জানা যায়, ১৮৬০ সালে প্রথম মুক্তার চাষ শুরু করেন জন লাটেনড্রেস নামের এক আমেরিকান। তাকেই মুক্তা চাষের প্রবর্তক হিসাবে ধরা হয়। এরও আগে স্পেনের সৈনিকেরা ভেনিজুয়েলা উপত্যকার ২০০ কিলোমিটার দূরে মুক্তার সন্ধান পায়। উনিশ শতকের শেষ দিকে জাপানের কোকিচি মিকিমোতে প্রথম সিনথেটিক পার্ল বা শংকর জাতীয় মুক্তার চাষ শুরু করেন।

সারা বিশ্বে অসংখ্য প্রজাতির ঝিনুক দেখতে পাওয়া যায়। তার মধ্যে পিস্কটাডা, মাটেনসি, পিস্কটাডা ম্যাস্কিমা, পিস্কটাডা মার্গারিটিপেরা, টোরিয়া ভালগারিস, লেমিলিডেন্স, সারজিনলি, ইউনিট, প্রেকুরাপ্লানসেটা ইত্যাদি প্রজাতির ঝিনুক থেকে উন্নতমানের মুক্তা পাওয়া যায়। মুক্তা প্রধানত তিন ধরনের হয়ে থাকে যথা (১) প্রাকৃতিক (২) কৃত্রিম ও (৩) প্রণোদিত উপায়ে উত্পাদিত মুক্তা। ঝিনুকের মধ্যে প্রাকৃতিক জলজ পরিবেশে যে মুক্তা জন্মে তাকে প্রাকৃতিক মুক্তা বলে। যান্ত্রিক উপায়ে মাছের নির্যাস থেকে যে মুক্তা তৈরি করা হয় তাকে কৃত্রিম মুক্তা বলে, যা অসাধু ব্যবসায়ীরা আসল মুক্তা হিসাবে চালিয়ে দেয়। আবার কোনো বহিরাগত বস্তু যেমন কাঁচের টুকরো, হাড়ের গুঁড়ো অসম আকৃতির মুক্তার কণা কিংবা পুঁটি মাছের চোখের শুকনো লেন্স ঝিনুকের দেহের বিশেষ অঙ্গে (প্রধানত বীজ কোষাবাস) প্রবেশ করিয়ে যে মুক্তা তৈরি করা হয় তাকে প্রণোদিত উপায়ে তৈরি মুক্তা বলে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের নোনা পানিতে ৩০০ প্রজাতির এবং মিঠা পানিতে ২৭ প্রজাতির ঝিনুক পাওয়া যায়। বাংলাদেশে ৫ ধরনের ঝিনুকে মুক্তা পাওয়া যায়। আমাদের দেশে ‘গোলাপী’ ও ‘চুর’ এ দু’ধরনের মুক্তা পাওয়া যায়। বাংলাদেশের অধিকাংশ জেলার ঝিনুকেই মুক্তা পাওয়া যায়। তবে বৃহত্তম ঢাকা, সিলেট, কুমিল্লা, বগুড়া, ময়মনসিংহ, পাবনা, টাঙ্গাইল, চট্টগ্রাম ও ফরিদপুরে উন্নতমানের গোলাপি মুক্তা পাওয়া যায়।

ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ মত্স্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) বিজ্ঞানীরা মিঠাপানির ঝিনুকে ব্যাপক সংখ্যক ইমেজ মুক্তা উত্পাদনে সফলতা অর্জন করেছে। ইমেজ মুক্তা এমন এক ধরনের মুক্তা যা সচরাচর দেখা যায় গোল মুক্তা থেকে আলাদা। এগুলো সাধারণত চ্যাপ্টা আকৃতির। ঝিনুকের ভেতরে কোনো কিছু নকশা বিশেষ পদ্ধতিতে স্থাপন করলে ধীরে ধীরে সে নকশাটি ধারণ করে মুক্তায়। বিজ্ঞানীরা জানান, ইমেজ ঝিনুকে স্থাপন করার জন্য সাধারণত বড় আকৃতির ও চ্যাপ্টা আকৃতির ঝিনুক বাছাই করা হয়। পরে মোম, প্লাস্টিক, স্টিল ইত্যাদি দিয়ে কোনো কিছুর নকশা (প্রতিচ্ছবি) তৈরি করে তা ঝিনুকের দেহের অভ্যন্তরে ম্যান্টাল টিস্যুর নিচে স্থাপন করা হয়। একটি ঝিনুকে ১০ থেকে ১৫টি মেন্টাল টিস্যু প্রবেশ করানো হয়। ফলে ১০ থেকে ১২টি পর্যন্ত মুক্তা পাওয়া যায়। টিস্যুর চারপাশে ন্যাকার সিক্রেশন অর্থাত্ এক ধরনের লালা নিঃসরণ হয়। ক্রমাগত নিঃসৃত এ লালা জমাট বেঁধে মুক্তায় পরিণত হয়। এ স্তরটি যতটা পুরু হয় মুক্তার আকারও তত বড় হয়। অপারেশনের পরে ঝিনুক পুকুর বা জলাশয়ে ছেড়ে দিলে ৭-৮ মাস পর যে নকশাটি ঝিনুকের ভিতরে স্থাপন করা হয়েছিল তার উপর প্রলেপ পড়ে হুবহু সেই আকৃতির ইমেজ মুক্তা উত্পাদিত হয়। এভাবে ইমেজ মুক্তায় বিভিন্ন নাম, পাখি, মাছ, নৌকা, অলংকার, কোর্ট পিন, সো পিসসহ নানা ধরনের দৃষ্টিনন্দন প্রতিচ্ছবি তৈরি করা হচ্ছে। যা নারীদের পোশাক পরিচ্ছদ সৌন্দর্য বর্ধক হিসাবে ব্যবহার করা হয়। আবার গৃহ সজ্জায়ও ইমেজ মুক্তার কদর পৃথিবী জুড়ে রয়েছে।

বাংলাদেশে চিংড়ি শিল্পের ন্যায় মুক্তা শিল্পের ভবিষ্যত্ উজ্জ্বল বলে মনে করা হয়। বাংলাদেশে রপ্তানি পণ্যের তালিকায় ইতোমধ্যেই মুক্তা একটি নতুন পণ্য হয়ে উঠেছে। মুক্তা চাষের মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মুক্তা চাষ করে সফলতা লাভ করেছে। লোনা পানির মুক্তা উত্পাদনকারী দেশগুলো হলো অস্ট্রেলিয়া, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও জাপান। আবার মিঠাপানির মুক্তা উত্পন্ন হয় চীন, জাপান ও আমেরিকায়। বাংলাদেশে বেশ কয় বছর আগে মুক্তা চাষ শুরু হয়। মুক্তা চাষ ও রপ্তানির ক্ষেত্রে সংযুক্ত আরব আমিরাতের অবস্থান শীর্ষে অবস্থান করছে। অন্যান্য শীর্ষ মুক্তা রপ্তানিকারক দেশ হচ্ছে জাপান, চীন, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইন্দোনেশিয়া ও সুইজারল্যান্ড।

ময়মনসিংহে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে স্থাপিত ও গবেষণাগার মুক্তা উৎপাদনে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে বলে মন্তব্য করেছে বিশেষজ্ঞরা। মুক্তা শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী বিজ্ঞানভিত্তিক চাষ ব্যবস্থাপনা। প্রযুক্তিগত আধুনিক চাষ ব্যবস্থাপনা কলাকৌশলের মাধ্যমে এ শিল্পের উন্নয়ন সম্ভব। বাংলাদেশে এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, প্রণোদিত উপায়ে মুক্তা চাষ করলে এ মূল্যবান সম্পদ হতে বছরে ১৫০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। তাছাড়া প্রায় ২০-৩০ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা আছে। উদ্যোক্তা ও গ্রামীণ পর্যায়ে এ প্রযুক্তি ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হলে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি রপ্তানি খাতেও ব্যাপক সম্ভাবনা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। মুক্তা চাষ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করা প্রয়োজন। সে সাথে দরকার সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা। বাংলাদেশের রপ্তানি বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে মুক্তা একটি সম্ভাবনাময় রপ্তানি পণ্য হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন।

সূত্র: ইত্তেফাকfavicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment