এইচএসসির ফলাফল ও আমাদের অস্থির শিক্ষা ব্যবস্থা

এইচএসসির ফলাফল ও আমাদের অস্থির শিক্ষা ব্যবস্থা

  • মুহাম্মদ মূসা

শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য জ্ঞানার্জন। জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা পরিভ্রমণ করে তা বাস্তব জীবনে কাজে লাগানোর উপযোগী করে তোলা। শিক্ষা গ্রহণ বা জ্ঞান অর্জনের জন্য থাকে বিভিন্ন পদ্ধতি বা উপায়। পরিবার এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এই দায়িত্ব নিয়ে থাকে। প্রত্যেক সমাজেই জ্ঞান সরবরাহ-প্রাপ্যতা নির্ধারণের একটা মাপকাঠি থাকে। আমাদের সমাজেও আছে। আমাদের দেশে বিভিন্ন পরীক্ষা জানান দেয় একজন শিক্ষার্থী কতটুকু শিখেছে। এমন পরীক্ষা দ্বারা প্রাথমিকভাবে একজন ছাত্রকে মূল্যায়ন করা গেলেও প্রকৃত মূল্যায়ন অসম্ভব। বলছিলাম আমাদের দেশের পাবলিক পরীক্ষাগুলোর কথা। স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর স্তরের জ্ঞানার্জনের মূল্যায়নও এর থেকে খুব একটা ভিন্ন নয়। মাধ্যমিক স্তরের এসএসসি বা সমমান আর উচ্চ মাধ্যমিকে রয়েছে এইচএসসি বা সমমান পরীক্ষা। শিক্ষার মান আর ফলাফল যাচাইয়ের গুরুত্বপূর্ণ স্তর এই দুইটি পরীক্ষা। সারা দেশের মানুষ তাকিয়ে থাকে এই দুইটি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ আর তাদের ফলাফলের দিকে। এই ফলাফলের উপর একদিকে যেমন নির্ভর করে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবনের ভবিষ্যত্; অন্যদিকে স্পষ্ট হয় দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার বাস্তব চিত্র।

 দেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা যে খুব খারাপ অথবা খুব ভালো তা বলছি না। তবে এইটুকু নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, পাঠদান আর মূল্যায়ন পদ্ধতির দ্রুত পরিবর্তনশীলতা ক্ষতিকর। কয়েক বছর ধরে এর ক্ষতিকর দিক আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বেশ প্রভাব ফেলেছে। গত কয়েক বছরের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলের দিকে খেয়াল করলে তা স্পষ্ট বুঝা যায়। ২০১৭ সালের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় ১১ লক্ষ ৮৩ হাজার ৬৮৬ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাসের হার ৬৮.৮১ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছে ৩৭ হাজার ৭২৬ জন। ২০১৬ সালে ১২ লক্ষ ৩ হাজার ৬৪০ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাসের হার ছিল ৭৪.৭০ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছে ৫৮ হাজার ২৭৬ জন। এর আগে ২০১৫ সালে ১০ লক্ষ ৬১ হাজার ৬১৪ পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাসের হার ছিল ৬৯.৬০ শতাংশ; জিপিএ-৫ ছিল ৪২ হাজার ৮৯৪ জন। ২০১৪ সালে পাসের হার ছিল ৭৮.৩৩ শতাংশ এবং জিপিএ-৫ পেয়েছে ৭০ হাজার ৬০২ জন। ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে পরীক্ষার্থী সংখ্যা এবং পাসের হার দুটোই কমেছে। পাসের হার কমেছে ৫.৮৯ শতাংশ এবং জিপিএ-৫ কমেছে ২০ হাজার ৩০৭ জন। তবে শতভাগ ফেল করা ২৫ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭২টিতে।

অন্যদিকে মাধ্যমিক স্তরের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায় ২০১৭ সালে পাসের হার ৮০.৩৫ শতাংশ জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লক্ষ ৪ হাজার ৭৬১ জন। ২০১৬ সালে এই পাসের হার ছিল ৮৮.২৯ শতাংশ এবং জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১ লক্ষ ৯ হাজার ৭৬১ জন। এর আগে ২০১৫ সালে পাসের হার ৮৭.০৪ শতাংশ; জিপিএ-৫ ছিল ১ লক্ষ ১১ হাজার ৯০১ জন এবং ২০১৪ সালে পাসের হার ছিল ৯১.৩৪ শতাংশ; যেখানে জিপিএ-৫ ধারীর সংখ্যা ১ লক্ষ ৪২ হাজার ২৭৬ জন। এখানে পাসের হার ২০১৬ সালে তার আগের বছরের তুলনায় ১.২৫ শতাংশ বাড়লেও এবছর ৭.৯৪ শতাংশ কমেছে। গত বছরের তুলনায় জিপিএ-৫ কমেছে ৫ হাজার। সংখ্যাটি দেখলে মনে হয় যেন ফলাফলটি এমন হয়নি বরং এমন করা হয়েছে।

এই দুইটি পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল দেখলে কেউ একজন স্বাভাবিকভাবে বলতে পারেন যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ খুব একটা বাড়েনি। আসলে তা নয়। পাঠ্যপুস্তক, সিলেবাস, পাঠদান পদ্ধতি, মূল্যায়ন পদ্ধতির বার বার পরিবর্তনের ফলে এমনটি হয়েছে। প্রতিবারই শিক্ষার প্রকৃত মানের দিকে না তাকিয়ে জিপিএ-৫ এবং পাসের হার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়েছে। সামান্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বা প্রশিক্ষণহীন শিক্ষকদের দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোতে চলে সৃজনশীল পাঠদান। পরিবর্তনশীল পাঠ্যপুস্তকে হিমশিম খায় অভিভাবকরা। ফলে কোচিং ব্যবসায়ীদের লুকোচুরি বেড়েই চলে। প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সরকার কোচিং বন্ধে বার বার ব্যর্থ হয়েছে। আসল কারণ পাঠ্যপুস্তকের দ্রুত পরিবর্তন, শিক্ষা ব্যবস্থার মূল্যায়নের ভিন্নতা, প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অপ্রতুলতা আর শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতির প্রভাবও অস্বীকার করার সুযোগ নেই। গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষাঙ্গনে এর পরিবর্তন আশঙ্কাজনক। বিশেষ করে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাঙ্গনগুলোতে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ ভয়াবহ হারে বেড়েছে। যার ফলে চেষ্টা করেও প্রশ্ন ফাঁস কাঙ্ক্ষিত হারে কমছে না। কমছে না পরীক্ষার হলে শিক্ষকদের দৌড়ঝাঁপ, অনৈতিক সহযোগিতা আর শিক্ষার্থীদের নকল। আশাকরি দ্রুত পরিবর্তনশীল এই শিক্ষা ব্যবস্থায় যারা স্বচ্ছভাবে পাস করেছে তারা কিছু জ্ঞান অর্জন করেছে। তবে বাস্তবতা আর সামাজিক মাধ্যমের ভাষ্য থেকে ভিন্ন বক্তব্য সরকারি প্রশাসনের। এবছর পাসের হার কম হলেও শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় এবং সরকারি আমলারা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা না থাকলে যা আছে তাই নিয়ে খুশি থাকার বিকল্প নেই। তবে একথা সত্য যে ফলাফল যেমনই হোক না কেন, এই শিক্ষার্থীরাই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে, মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হবে। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তাই এদের সুশিক্ষা নিশ্চিত করা সমৃদ্ধ জাতি গড়ার পূর্বশর্ত। কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থার দ্রুত পরিবর্তন আর দুর্বোধ্যতা সুশিক্ষার পথে অন্যতম বাধা। আমাদের উচিত হবে শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তনে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাবের বিষয়টি মাথায় রেখে পরিকল্পনা নেওয়া।

মুহাম্মদ মূসা: শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: ইত্তেফাকfavicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment