বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংঙ্কিং নিয়ে প্রশ্ন

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংঙ্কিং নিয়ে প্রশ্ন

  • ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে চলতি বছরের ১০ নভেম্বর বাংলা ট্রিবিউন-ঢাকা ট্রিবিউনের যৌথ উদ্যোগে র‌্যাঙ্কিং নির্ণয়বিষয়ক এক গবেষণাপত্র প্রকাশ করা হয়। বস্তুগত ও ধারণাগত তথ্য থেকে প্রাপ্ত স্কোরের সমন্বয়ে এই র‌্যাংঙ্কিং করা হয়, যার মধ্যে বস্তুগত তথ্য থেকে ৪০ শতাংশ এবং ধারণাগত তথ্য থেকে ৬০ শতাংশ স্কোর নিয়ে মোট ১০০ স্কোরের মধ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাঙ্কিং নির্ধারণ করা হয়েছে।

বস্তুগত তথ্যের ক্ষেত্রে ইউজিসি থেকে প্রাপ্ত ২০১৪ সালের তথ্য নেয়া হয়েছে। অপরদিকে ধারণাগত তথ্যের ক্ষেত্রে ইউনিভার্সিটির শিক্ষাবিদ (ডিন, বিভাগীয় প্রধান, অধ্যাপক, রেজিস্ট্রার) এবং চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মানবসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তাদের ওপর জরিপ পরিচালিত হয়।

ধারণাগত জরিপটি মোট ৩০০ জনের ওপর পরিচালনা করা হয়েছে, যার মধ্যে ১৫০ জন শিক্ষাবিদ এবং ১৫০ জন মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক। বাংলাদেশের ৮৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্য থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ৩২টি বাছাই করে নেয়া হয়। তার মধ্যে থেকেই গবেষণার মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়েছে সেরা ২০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এতে প্রথম হয়েছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে যথাক্রমে অবস্থান করছে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, আর দশম স্থানে রয়েছে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সংখ্যা, গবেষণা, ক্যাম্পাস, শিক্ষা কার্যক্রম, লাইব্রেরির অবস্থা, পাস করা শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে শিক্ষক ও চাকরিদাতাদের ভাবনার ভিত্তিতে এই র‌্যাংঙ্কিং হয়েছে।

গত ১১ নভেম্বর গবেষণাপত্র প্রকাশের পর থেকেই এ গবেষণা নিয়ে অনেকের মাঝেই (বিশেষ করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবক) নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে এ ধরনের র‌্যাংঙ্কিং প্রশংসনীয় এবং এর মাধ্যমে প্রতিটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় তার অবস্থান বুঝে র‌্যাঙ্কিং-এ ওপরে উঠে আসার চেষ্টা করতে পারে। এ ধরনের গবেষণা বা র‌্যাংঙ্কিংয়ের ফলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতার মনোভাব সৃষ্টি হয়, যা উচ্চশিক্ষায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। সর্বোপরি, এ ধরনের র‌্যাংঙ্কিং অব্যাহত থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর ভালো করার চাপ থাকবে। মূলত এভাবেই সারা পৃথিবীর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাংঙ্কিং শুরু হয়েছে এবং তা মানসম্মত অবস্থায় পৌঁছেছে। সুতরাং বাংলাদেশে গুণগত ও মানসম্মত আন্তর্জাতিক মানের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করতে এ ধরনের গবেষণার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। তবে তা অবশ্যই হতে হবে সমসাময়িক, বস্তুনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ তথা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এবং আন্তর্জাতিক মানের। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ওআরজি কোয়েস্ট রিসার্চ লিমিটেড এবং বাংলা ট্রিবিউন-ঢাকা ট্রিবিউনের যৌথ উদ্যোগে র‌্যাঙ্কিং নির্ণয়বিষয়ক গবেষণাপত্রে এগুলোর অনেক কিছুই আসেনি।

যেমন : এখানে র‌্যাংঙ্কিংয়ের জন্য যে সব প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে তার অনেকটাই অসম্পূর্ণ; র‌্যাংঙ্কিং পদ্ধতির বিবেচ্য অনেক বিষয়, নানা গাণিতিক ফলাফলসহ অনেক তথ্য-উপাত্ত অস্পষ্ট। প্রশ্ন থেকে যায়, এই র‌্যাংঙ্কিংয়ে ধারণাগত ডাটাগুলো ভালো হলেও একাডেমিক তথ্য যারা দিয়েছেন, তারা অন্য বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে নিরপেক্ষ তথ্য কি দিতে পারবেন? পাশাপাশি এই র‌্যাংঙ্কিং করার ক্ষেত্রে এতে কতটুকু সমসাময়িক ও নিরপেক্ষ ডাটা বা তথ্য ব্যবহার করে এটি তৈরি করা হয়েছে এটিও একটি প্রশ্ন। বাংলাদেশের এত বিশাল উচ্চশিক্ষার পরিমণ্ডলের মধ্যে মাত্র ১৫০ জন শিক্ষাবিদ এবং ১৫০ জন মানবসম্পদ ব্যবস্থাপকের মতামত কি এ ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত হতে পারে? সর্বোপরি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইউজিসি ছাড়া এ ধরনের র‌্যাংঙ্কিং করার জন্য অন্য প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন আছে কিনা তাও প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়। বলা বাহুল্য, এ সব র‌্যাংঙ্কিং তখনই সর্বজনগ্রাহ্য হতে পারে যখন এতে বাস্তব অবস্থা এবং সমসাময়িক তথ্য-উপাত্তের ব্যবহার করা হবে।

গবেষণায় ধারণাগত স্কোরের ক্ষেত্রে শিক্ষার পরিবেশ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো, শিক্ষকদের মান, চাকরি ক্ষেত্রে পাস করা শিক্ষার্থীদের কর্মদক্ষতা, নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা, যোগাযোগ দক্ষতা ইত্যাদি দেখানো হয়েছে। কিন্তু কাদের কাছ থেকে এবং কিসের ভিত্তিতে এসব জরিপ পরিচালনা করা হয়েছে সে সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা নেই এই গবেষণাপত্রে। উন্নত বিশ্বে র‌্যাঙ্কিংয়ে যে বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়, তার অনেক কিছুই এ গবেষণায় আসেনি। ফলে দেখা যাচ্ছে যে, এই গবেষণায় প্রকৃত তথ্যের প্রতিফলন ঘটেনি এবং এই র‌্যাঙ্কিংয়ের মাধ্যমে এক অর্থে উচ্চশিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি সামগ্রিকভাবে উচ্চশিক্ষা খাতকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে এবং এর ফলে সত্যিকার অর্থে গুণগত ও মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অবমূল্যায়িত হয়েছে।

বর্তমান যুগ চরম এক গতিশীল একটি যুগ। প্রতিনিয়তই এখানে তথ্য-উপাত্তের পরিবর্তনসহ নানা কিছুরই পরিবর্তন ঘটছে। একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করা যেতে পারে। যেমন : বর্তমান সময়ে সকালে কেনা একটি মোবাইল ফোন ওইদিন বিকালেই পুরনো হয়ে যাচ্ছে। কারণ ইতিমধ্যে ওই মোবাইল ফোনের আপডেটেড সংস্করণ বের হয়ে গেছে। এই হচ্ছে বর্তমান সময়ের বাস্তব অবস্থা এবং তা সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন। এই সময়ে চার বছর আগের তথ্য দিয়ে গবেষণাপত্র প্রকাশপূর্বক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে র‌্যাংকিং করা কতটুকু যৌক্তিক এবং তা সবার কাছে কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে বা হচ্ছে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। আর এ ধরনের গবেষণা বা র‌্যাংঙ্কিং কি শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ বর্তমান প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করবে না? যদি বিভ্রান্ত করেই থাকে, তাহলে এর জন্য দায়ী কে এবং এই দায় কে বহন করবে?

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন হচ্ছে দেশের পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা। দেশের পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পৃথকভাবে নিয়ে ইউজিসি যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রকৃত ও সমসাময়িক তথ্য-উপাত্ত নিয়ে সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষভাবে এ ধরনের র‌্যাংঙ্কিং করার উদ্যোগ গ্রহণ করে, তবে তা দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন তথা উন্নয়ন ঘটাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা যায়। উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ৮ জুন অনুষ্ঠিত ইউজিসির এক সভায় দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাংঙ্কিং (অবস্থান নির্ধারণ) করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সেই সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন জনগণের চোখে পড়েনি। তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাংঙ্কিং বিষয়ক ওই সিদ্ধান্তের বাস্তবায়নে ইউজিসির দ্রুত এগিয়ে আসা প্রয়োজন।

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; সদস্য, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল

সূত্র: যুগান্তর

Sharing is caring!

Leave a Comment