উদ্যোক্তাদের কেন দেনদরবার করতে হয় ?

উদ্যোক্তাদের কেন দেনদরবার করতে হয় ?

  • সাজ্জাদ আলম খান

চলছে আগামী বাজেট নিয়ে আলোচনা। সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী তাদের অনুকূলে আর্থিক সুবিধা ও প্রণোদনা পেতে চালিয়ে যাচ্ছেন নানা ধরনের প্রয়াস। নিজেরা তো দরকষাকষি করছেন, সেই সঙ্গে সক্রিয় করেছেন লবিস্ট গ্রুপকেও। যদিও লবিস্টদের কার্যক্রম আইনগতভাবে সিদ্ধ না হওয়ায় খোলা চোখে তেমন দেখা মেলে না। পিছিয়ে থাকা গোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর আমলাতন্ত্রের বেড়াজাল ডিঙিয়ে সহজেই নীতিনির্ধারকদের কাছে পৌঁছে না। আর দরজায় কড়া নাড়লেও তেমন সদুত্তর পায় না তারা। এ অবস্থায় সৃজনশীল উদ্যোক্তাদের আনুকূল্য পাওয়ার পথ খুবই সংকুচিত।

সৃষ্টিশীল কাজের মাধ্যমে যারা কর্মসংস্থানের পথ খুঁজতে চায়, তাদের যদি দেনদরবার করতে হয় পথে পথে, তাহলে উদ্যোগ বিকশিত না হয়ে উল্টো পথে যাবে। হতোদ্যম হয়ে পড়বে তরুণরা। তবুও বাজেট যেহেতু আর্থিক ও রাজনৈতিক বিবেচনায় বড় মাপের দলিল, সেখানে প্রতিচ্ছাপ না থাকলে কি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল বা বিকল্প তহবিল সহজে গড়ে উঠতে পারবে? আর এই বাজেটেই তো সরকারের জনতুষ্টি পরিকল্পনা প্রকাশ পাওয়ার কথা।

২০২১ সাল নাগাদ মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখাচ্ছে সরকার। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ স্বপ্ন পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে এ তহবিল। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কাজ করার যে মেধা আমাদের দেশে রয়েছে, তা কাজে লাগাতে পারলে অর্থনীতি অনেক দূর এগিয়ে যাবে। এই তহবিলের মাধ্যমে কর্মসংস্থানও তৈরি হবে। উন্নত বিশ্ব এ ধরনের তহবিলের কোম্পানিকে কর অবকাশ সুবিধাসহ প্রণোদনা দিয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে অবস্থা উল্টো। উদ্যোক্তা, ফান্ড ব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগকারী তিনজনকেই পৃথক কর দিতে হয়। এটি এখন একটি বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বস্টন কনসাল্টিং ফার্মের জরিপ মতে, দুই-তৃতীয়াংশের বেশি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগের মাধ্যমে তাদের বার্ষিক আয় কমপক্ষে ২০ শতাংশ বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। ভেঞ্চার ক্যাপিটালপুষ্ট নতুন ব্যবসা কর্মসংস্থান তৈরি ও সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি করে। তবে এ জন্য প্রয়োজন কার্যকর ইকোসিস্টেম। দেশে এখনও ব্যাংকিং বিনিয়োগে আধিপত্য চলছে।

উন্নত বিশ্বে এ ধরনের তহবিলের অনুশীলন অনেক আগে থেকেই চলছে। বিশ্বে এ ধরনের দেড় হাজারের বেশি কোম্পানি রয়েছে। ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ আড়াই ট্রিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। বাংলাদেশে ২০১৫ সালে এ সংক্রান্ত আইন পাস হয়। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, বিএসইসি ও ব্যক্তিখাতকে এর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার অনুমোদন দিচ্ছে। তবে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের মধ্যে অভ্যস্ততা গড়ে উঠতে সময়ের প্রয়োজন। দেশে আটটি প্রতিষ্ঠান বিকল্প বিনিয়োগ তহবিল পরিচালনায় নিবন্ধন নিয়েছে।

বাগডুম ডটকম, সহজ ডটকম, চালডাল ডটকম, আজকের ডিল ডটকমসহ বেশ কয়েকটি বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান ভেঞ্চার ক্যাপিটালের বিনিয়োগ পেয়েছে। সিলিকন ভ্যালিভিত্তিক ফেনক্স ভেঞ্চার ক্যাপিটাল এই বিনিয়োগ করেছে।

দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিকে উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে এই বিকল্প তহবিল। উদ্যোক্তাকে বিনা সুদে মূলধন সরবরাহের পাশাপাশি নতুন প্রতিষ্ঠানকে দক্ষতা ও কারিগরি সহায়তা দেয়া যায় এখান থেকে। সারা দেশে ছড়িয়ে আছেন অনেক স্বপ্নবাজ তরুণ উদ্যোক্তা। যাদের ভালো আইডিয়া আছে, শারীরিক সক্ষমতা ও ইচ্ছা আছে; কিন্তু নেই বিনিয়োগ সামর্থ্য। এজন্য আইডিয়াটাকে তারা বাস্তবে রূপ দিতে পারছেন না। তবে বাধার এ প্রাচীর টপকানো সহজ ভেঞ্চার ক্যাপিটালের সহযোগিতায়।

যদিও প্রশ্ন আছে ঝুঁকি নিয়ে, তবে এটা তো সত্য- বিনা ঝুঁকিতে ব্যবসা হয় না। ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি এমন সব ব্যক্তি বা উদ্যোগে বিনিয়োগ করে, যেখানে জামানত দেয়ার কিছু থাকে না। তাতে কী! সত্তর দশকে বিনা জামানতে শুধু পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কর্মস্পৃহাকে সামনে রেখে শুরু হয়েছিল ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম। তার বিজয়রথ এখনও চলছে। সাক্ষর-জ্ঞানহীন নারী, যাদের বেশিরভাগেরই ছিল না প্রশিক্ষণ, তারা অল্প অর্থ নিয়ে পাল্টে দিয়েছেন তাদের জীবনমান। আর এই বিশেষ তহবিল যাচ্ছে, শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে সৃজনশীল তরুণদের কাছে। আর জামানত রাখলেও বা কী? ব্যাংকিং খাতে এখন খেলাপি ঋণের পাহাড়। এই বোঝা বেড়ে চলছে। এর পরিমাণ প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা।

সৃজনশীল উদ্যোক্তাদের কে পথ দেখাবে? আশির দশকের শুরুতে সোনালী ব্যাংক জামানতবিহীন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্মসংস্থান প্রকল্প ‘বিকল্প’ গ্রহণ করেছিল। শিক্ষা সনদ গচ্ছিত রেখে ঋণ দেয়া হতো স্নাতকদের। মুদ্রণ, গাড়ি, চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলা হয়েছিল এ প্রকল্পের আওতায়। প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান করতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। কিন্তু তারও খুব একটা সফলতার গল্প নেই। সামরিক শাসনের সময় উপরওয়ালাদের নির্দেশে এক সময় বন্ধ হয়ে যায় ‘বিকল্প’, যা হয়ে উঠতে পারত একটি নতুন মডেল। তবে মধ্য-নব্বই দশকে এসব ঋণ নিয়ে ব্যাংকের সঙ্গে বিকল্প উদ্যোক্তাদের এক ধরনের সমঝোতা হয়। ছাড় দিতে বাধ্য হয় সোনালী ব্যাংক। তবে এসব স্নাতকধারীরা প্রচলিত ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছিল। সৃজনশীল তেমন কোনো উদ্যোগ মেলেনি তখন।

কিন্তু ভেঞ্চার ক্যাপিটাল বা বিকল্প তহবিলের যারা সহযোগিতা নেবেন, তারা তো ভিন্নমাত্রার চিন্তাশীল তরুণ। যার ব্যবসা শুরুতে থাকে শুধু বাস্তবমুখী পরিকল্পনা। প্রয়োজন হয়ে পড়ে অর্থ, অভিজ্ঞতা আর উদ্যম। শুরুতে অর্থ লগ্নির জন্য পরিবার-পরিজনদের কাছে ধরনা দেন। সম্ভাবনায় সাফল্যের আলো দেখা মিললে বড় বিনিয়োগ দরকার হয়। তখন নতুন উৎসের খোঁজে নামতে হয়। সাধারণত এ ধরনের প্রয়োজনে ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের শরণাপন্ন হয়। কিন্তু ব্যাংক নতুন উদ্যোক্তাদের টাকা দিতে চায় না। ব্যাংক খোঁজে উদ্যোক্তার অভিজ্ঞতা, জামানত রাখার মতো সম্পদ। তারপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে টাকা ফেরতে আস্থাশীল হলে তবে মেলে ঋণ। যদিও এতসব বিবেচনায় দেয়া ঋণও খেলাপি হচ্ছে বছরের পর বছর। উল্লেখযোগ্য মুনাফা অর্জনকারী নতুন কোম্পানি পুঁজিবাজারে প্রবেশের অনুমতি পায়। কিন্তু সৃজনশীল এসব উদ্যোগে মুনাফার জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয়। যে সময় পুঁজির প্রয়োজন, তখন অবশ্য মুনাফা অর্জন সম্ভব নয়। ফলে প্রথাগত ব্যাংকিং সিস্টেম এবং পুঁজিবাজার- এই দু’জায়গা থেকেই স্টার্ট-আপগুলো বিনিয়োগ আকর্ষণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়।

তবে ভেঞ্চার ক্যাপিটালে ব্যাংকের মতো শর্ত নেই। এই তহবিলের কাজ হচ্ছে অভিনব এবং সৃজনশীল কিন্তু সম্ভাবনাময় উদ্যোগে বিনিয়োগ করা। পেনশন ফান্ড, দাতব্য তহবিল, বিভিন্ন ফাউন্ডেশন, কর্পোরেশন ও বিনিয়োগকারীরা এই তহবিলে মূলধন জোগান দেন। এই তহবিলকে অবশ্যই বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের স্বীকৃতি পেতে হবে। ভেঞ্চার ক্যাপিটালে শুধু প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে শেয়ার বেচাকেনা হয়। এর শেয়ার সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে না। ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টরা দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করে না। গ্রহণযোগ্যতা না পাওয়া পর্যন্ত নতুন কোম্পানির সামগ্রিক হিসাবপত্র এবং অবকাঠামোয় বিনিয়োগ চলতে থাকে ও কোম্পানিটিকে বৃহৎ কর্পোরেশনের কাছে বিক্রির উপযোগী করে তোলেন। মূলত ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট উদ্যোক্তার আইডিয়ার অংশীদারিত্ব কেনেন। নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পুষ্টি জোগান এবং ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকারের সহযোগিতায় মুনাফাসহ বিনিয়োগ তুলে নেন।

ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টরা যে কোনো কোম্পানির বাণিজ্যিক জীবনচক্রে বিনিয়োগ করতে পারেন। একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই বিনিয়োগ করলে, বলা হয় ‘সিড ইনভেস্টিং’। মাঠে গড়ানোর পর বিনিয়োগ করা হলে বলা হয় ‘আরলি স্টেজ ইনভেস্টিং’। আর প্রয়োজনের তুলনায় কম সম্পদ ও জনবল নিয়ে চলা কোম্পানিতে করলে বলা হয় ‘এক্সপ্যানশন স্টেজ ইনভেস্টিং’। ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি প্রযুক্তি এবং স্বাস্থ্যসেবায় বিনিয়োগে বেশি আগ্রহী। তবে নির্মাণ, শিল্পপণ্য, বাণিজ্যসেবা ইত্যাদি খাতেও বিনিয়োগ করে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে উদ্যোক্তা তৈরি ও উন্নয়নে ম্যাচিং ফান্ডের ব্যবস্থা রয়েছে। বাংলাদেশেও এই খাতের প্রসারে স্থানীয় এবং সিলিকন ভ্যালির সমন্বয়ে ম্যাচিং ফান্ডের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। বড় বড় শিল্পপতি, কর্পোরেট হাউসগুলো যাতে এই খাতে বিনিয়োগ করে, সেজন্য তাদের প্রণোদনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

নতুন কোম্পানির পোর্টফোলিও উন্নয়নের মাধ্যমে বিনিয়োগ ঝুঁকি কমিয়ে আনে এসব প্রতিষ্ঠান। গত কয়েক দশক ধরে মার্কিন ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টরা নতুন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এবং উদ্যোক্তাগোষ্ঠীকে সহায়তা দিয়ে আসছে। এতে তৈরি হয়েছে অগণিত কর্মসংস্থান। বেড়েছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা। অ্যাপল, ফেডারেল এক্সপ্রেস, কমপ্যাক, সান মাইক্রোসিস্টেমস, ইন্টেল, মাইক্রোসফট, গুগলের মতো বহুজাতিক কোম্পানি ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টদের হাত ধরেই উঠে এসেছে।

তথ্যপ্রযুক্তিতে বিশ্বের শীর্ষ কোম্পানিগুলোর দিকে তাকিয়ে বলা চলে, বাংলাদেশে বিশ্বজয়ী উদ্যোগ তৈরিতে ভেঞ্চার ক্যাপিটালের বিকল্প নেই! বাগডুম ডটকম, সহজ ডটকম, চালডাল ডটকম, আজকের ডিল ডটকমসহ বেশ কয়েকটি বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান ভেঞ্চার ক্যাপিটালের বিনিয়োগ পেয়েছে। সিলিকন ভ্যালিভিত্তিক ফেনক্স ভেঞ্চার ক্যাপিটাল এই বিনিয়োগ করেছে। আরও কিছু ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ভালো উদ্যোগ পেলে ‘দ্য গেইম চেঞ্জার’ হিসেবে কাজ করবে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠান।
সাজ্জাদ আলম খান : সাংবাদিক

সূত্র: যুগান্তরfavicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment