‘উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য স্কলারশিপ বাতিল করে দেই’

‘উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য স্কলারশিপ বাতিল করে দেই’

  • উদ্যোক্তা ডেস্ক

বুয়েটের শিক্ষাজীবন শেষে লোভনীয় চাকরি, বিদেশে স্কলারশিপের সুযোগ ছেড়ে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে স্টার্টআপ বা নতুন ব্যবসা শুরু করেন তরুণ উদ্যোক্তা হাবিব উল্লাহ বাহার। বর্তমানে তিনি বিশেষ ধরনের তদারকি সফটওয়্যার প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ফিল্ডবাজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। পড়ুন তাঁর সাক্ষাৎকার।


: কখন, কেন এবং কীভাবে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে স্টার্টআপ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হলেন?

হাবিব উল্লাহ বাহার: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলাম। ছাত্রাবস্থায়ই আমার স্বপ্ন ছিল নিজে উদ্যোক্তা হব। ব্যবসা-বাণিজ্য করব। যেহেতু কম্পিউটার বিজ্ঞানে পড়াশোনা, তাই ছাত্রাবস্থায়ই সিম্ফনির সঙ্গে কিছু কাজ করি। এর বাইরে আরও কিছু স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের হয়ে তথ্যপ্রযুক্তি-সংক্রান্ত বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সমাধানে কাজ করেছি। এসব কাজ করতে গিয়ে দেখলাম টাকা পাচ্ছি, কিন্তু নিজের কাজের স্বীকৃতি কোথাও মিলছে না। তখন ঠিক করি, নিজেই কিছু করব। সেই চিন্তা থেকে অনার্স পাসের পর ২০১১ সালে কয়েকজন বন্ধু মিলে ব্যবসা শুরু করি। তার আগে ২০০৯ সালে প্রোগম্যাটিক নামে নিজের একটি কোম্পানি গঠন করেছিলাম।

: বন্ধুদের নিয়ে কী ধরনের ব্যবসা শুরু করেছিলেন?

হাবিব উল্লাহ বাহার: ২০১১ সালে আমরা চারজন মিলে সিক্স ডিগ্রি নামে একটি কোম্পানি চালু করি। সেই কোম্পানির আওতায় এনিগমা নামের একটি ট্যাব বাজারে এনেছিলাম। প্রযুক্তিবিষয়ক জ্ঞান থাকলেও ওই সময় আমার প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনা ও ব্যবসার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। তাই প্রথম oqxymjtsউদ্যোগটিতে একটা ধাক্কা খেলাম। ধাক্কা খেলেও যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, তা পরবর্তী সময়ে আমাকে ব্যবসায় ও প্রতিষ্ঠান চালাতে সহায়তা করেছে।

: প্রথম ব্যবসায় ধাক্কা খাওয়ার পর কী করলেন?

হাবিব উল্লাহ বাহার: ব্যবসা ও নিজে কিছু করার ভাবনার মাঝে একবার ভেবেছিলাম দেশের বাইরে চলে যাব। যুক্তরাষ্ট্র থেকে একটা স্কলারশিপ পেয়ে গেলাম। কিন্তু নিজে উদ্যোক্তা হব এই স্বপ্নের সঙ্গে আপস করতে কিছুতেই মন চাইছিল না। তাই স্কলারশিপ বাতিল করে দিলাম। ২০১২ সালে আবারও নিজের প্রতিষ্ঠান প্রোগম্যাটিককে নতুনভাবে শুরু করি। বেশ ভালো করতে শুরু করি। কিন্তু আমার স্বপ্ন ও ইচ্ছা নিজের একটি ব্র্যান্ড দাঁড় করাব; সেটি হচ্ছিল না। আবার মূলধনও খুব বেশি ছিল না, তাই বেশি দূর এগোতে পারছিলাম না। এর মধ্যে বাংলাদেশের এক আয়োজনে জার্মান নাগরিক অ্যালেক্স রলিনসনের সঙ্গে পরিচয় হয়। পরবর্তী সময়ে ২০১৪ সালে এসে তাঁর সঙ্গে মিলে ফিল্ডবাজ নামে নতুন কোম্পানি গঠন করি। কোম্পানির নাম ও আমাদের সফটওয়্যারের নাম একই।

: ফিল্ডবাজ দিয়ে কী ধরনের ব্যবসা শুরু করেছেন?

হাবিব উল্লাহ বাহার: ফিল্ডবাজের রেজিস্ট্রেশন আমরা করিয়েছি জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে। এটির প্রধান কার্যালয় বাংলাদেশে। পরবর্তী সময়ে অবশ্য বাংলাদেশেও কোম্পানিটির রেজিস্ট্রেশন নেওয়া হয়েছে। ফিল্ডবাজ নামেই আমাদের তৈরি করা সফটওয়্যার দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বড় বড় প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করছে।

: বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে প্রথমে জার্মানিতে কেন কোম্পানিটির রেজিস্ট্রেশন করলেন?

হাবিব উল্লাহ বাহার: ব্যবসার শুরু থেকে সবচেয়ে বেশি যে সমস্যাটির মুখোমুখি হয়েছি, তা হলো চলতি মূলধনের ঘাটতি। এখনো পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে টাকা ধার করতে হয়। শুরু থেকে তাই আমরা ঠিক করি, ইউরোপে এটির রেজিস্ট্রেশন করাব, যাতে পরবর্তী সময়ে ভেঞ্চার ক্যাপিটালের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় মূলধন সংগ্রহ করতে পারি। আইটি ব্যবসায় স্থায়ী সম্পদের পরিমাণ কম। তাই এ দেশে কেউ প্রয়োজনীয় মূলধন দিতে চায় না। আবার যা-ও দিতে রাজি হয়, তাতে প্রয়োজন মেটে না। কিন্তু বিদেশে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল থেকে কার্যাদেশের বিপরীতে নামমাত্র সুদে মূলধন সংগ্রহ করা যায়।

: কী ধরনের সফটওয়্যার তৈরি করছেন? কারা সেগুলো ব্যবহার করছে?

হাবিব উল্লাহ বাহার: আমাদের সফটওয়্যারটি মূলত বিপণন ও উন্নয়নকাজের মনিটরিং-সংক্রান্ত। এই সফটওয়্যার ব্যবহার করে যেকোনো কোম্পানি তাদের গ্রাহক পর্যায়ের পণ্যের বিপণন ও মজুতসংক্রান্ত তথ্য জানতে পারবে।

: একটু ব্যাখ্যা করে বলবেন কি?

হাবিব উল্লাহ বাহার: ধরা যাক, কোনো একটি কোম্পানি বিস্কুট বিক্রি করে। সারা দেশে কোম্পানিটির পণ্য ডিলার হয়ে খুচরা বিক্রেতাদের হাতে যায়। সেখান থেকে গ্রাহকের কাছে। ব্যবস্থাটি দেখভাল করার জন্য কোম্পানির পক্ষ থেকে মাঠপর্যায়েও বিক্রয় প্রতিনিধি থাকেন। তাঁদের মাধ্যমে নানা হাত হয়ে কোম্পানি পণ্যের বিক্রি ও চাহিদাসংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। তাতে অনেক সময় লেগে যায়। এ ছাড়া কোম্পানি মাঠপর্যায়ের যথাযথ তথ্য না-ও পেতে পারে। কিন্তু আমাদের সফটওয়্যারটি ব্যবহার করলে মাঠপর্যায়ের নির্ভুল তথ্য দ্রুত জানা সম্ভব। ধরা যাক, কোম্পানির পক্ষ থেকে প্রত্যেক বিক্রয়কর্মীর হাতে আমাদের সফটওয়্যার-সমেত একটি করে মুঠোফোন দেওয়া হলো। সেই সফটওয়্যার ব্যবহার করে বিক্রয়কর্মীর পক্ষে মাঠপর্যায়ের সব তথ্য দ্রুত কোম্পানির সার্ভারে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। সফটওয়্যারটিতে এমন ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, কোনো বিক্রয়কর্মী মাঠে না গিয়ে ঘরে বসে তথ্য সংযুক্ত করলে জিপিআরএসে সেটি শনাক্ত করা যাবে।

proxy: বর্তমানে কোন কোন প্রতিষ্ঠান আপনাদের এই সফটওয়্যার ব্যবহার করছে?

হাবিব উল্লাহ বাহার: আফগানিস্তানের তালু কান, মাজার শরিফসহ চারটি প্রদেশে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান কেএফডব্লিউ ও আগা খান ফাউন্ডেশন যে উন্নয়নমূলক কাজ করছে, তা তদারকিতে ফিল্ডবাজ সফটওয়্যারটি ব্যবহার করছে। জার্মানিতে মিউনিখ রে নামের ইউরোপের একটি বিমা প্রতিষ্ঠানও ফিল্ডবাজ ব্যবহার করছে। এর বাইরে দেশে ক্রাউন সিমেন্ট, ফুডেক্স ইন্টারন্যাশনাল, গ্রামীণ ডানোন, কেয়ারের জিতা বাংলাদেশ নামের প্রকল্পে ফিল্ডবাজ ব্যবহৃত হচ্ছে। এ ছাড়া কলম্বিয়ায় ইউনিলিভারের সঙ্গেও আমাদের চুক্তি হয়ে গেছে। যেহেতু আমাদের কাজটি তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর সেবাসংক্রান্ত, তাই একেকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ৫ থেকে ১০ বছরের চুক্তি হয়।

: ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

হাবিব উল্লাহ বাহার: ফিল্ডবাজকে বিলিয়ন ডলারের কোম্পানিতে পরিণত করতে চাই। আগামী জানুয়ারিতে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে ফিল্ডবাজের আর্থিক মূল্যমান (ভ্যালুয়েশন) যাচাই করা হবে। আমাদের ধারণা, বর্তমানে এটির আর্থিক মূল্যমান ১ কোটি ডলারে দাঁড়াবে। এরপর বিদেশ থেকে কিছু মূলধন সংগ্রহের পরিকল্পনা রয়েছে। এর মাধ্যমে আমরা কোম্পানিটিকে ২০১৯ সালের মধ্যে ১০০ কোটি ডলারের কোম্পানিতে পরিণত করতে চাই।

: তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে ব্যবসা করতে গিয়ে কী ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে?

হাবিব উল্লাহ বাহার: চলতি মূলধনের বাইরে আরও বেশ কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে আমাকে। ব্যবসা শুরুর জন্য ছাত্রাবস্থায় কোম্পানির ট্রেড লাইসেন্স নিতে গিয়ে দেখলাম, নির্ধারিত ফির বাইরে বাড়তি টাকা ছাড়া কাজটি সম্ভব নয়। ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়ে যায় শুধু ট্রেড লাইসেন্স করাতে গিয়ে। ছাত্রাবস্থায় ওই পরিমাণ টাকাও জোগাড় করা ছিল কষ্টকর। এরপর যখন এক বিদেশিকে নিয়ে ফিল্ডবাজ গঠন করলাম, তখন তার বিপরীতে ব্যাংক হিসাব খুলতে গিয়ে নানা জটিলতায় পড়তে হয়। সাত মাসেরও বেশি সময় লাগে একটা ব্যাংক হিসাব খুলতে। আর তরুণ হিসেবে আমরা যখন সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যাই, তখন আমাদের উদ্যোগগুলোকে খুব বেশি মূল্যায়ন করা হয় না। এসব সমস্যা দূর করতে হলে নতুন ব্যবসা বা স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানের জন্য সরকারি উদ্যোগে একটি সমন্বিত সেল গঠন করা দরকার, যেখান থেকে সব ধরনের সমস্যার সমাধান মিলবে।

সূত্র: প্রথম আলোfavicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment