চীন কেন প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবসায় গুরুত্ব দিয়েছে?

চীন কেন প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবসায় গুরুত্ব দিয়েছে?

  • মো. সাইফ

চীনে নতুন নতুন প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের প্রচেষ্টার ধারা খুবই শক্তিশালী হচ্ছে। এর পেছনে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করছে প্রযুক্তিনির্ভর বড় জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর দেশে এবং দেশের বাইরে অভাবনীয় সফলতা। এছাড়া দেশটির সরকারের ‘জনগণ করবে উদ্ভাবনের নতুন ধারা’ শিরোনামে একটি কার্যক্রম  তাদের সাহস যোগাচ্ছে। তাই উদ্ভাবনের উদ্যম আগের চেয়ে আরো বাড়ছে তাদের। এটি তাদের ১৩তম পঞ্চবার্ষিকী (২০১৬-২০২০) পরিকল্পনার অংশ। ধারনা করা হচ্ছে এটি বাণিজ্যিক অগ্রগতিকে আরও তরানিত্ব করবে। বর্তমানে নির্মাতা এবং বিনিয়োগকারীরা প্রযুক্তিগত উদ্যোগগুলোর দিকে ধাবিত হচ্ছে ঝুঁকি এবং বাজারের বহুল প্রতিযোগিতা স্বত্বেও। প্রযুক্তি-উদ্যোক্তাদের থেকেই এই খাতে বিপুল পরিমাণ চাহিদার সৃষ্টি হয়েছে। শুধু অর্থনৈতিক কারণেই নয়, এটা সম্ভব হয়েছে টেকনোলজি, বাজার ব্যবস্থাপনা এবং উদ্যোক্তা উন্নয়নের কারণে।

হংকংকে চীনের মূল ভুখণ্ডের প্রযুক্তি-উদ্যোক্তাদের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে যারা ক্রমশ প্রবেশাধিকার বাড়াতে চাচ্ছে বিদেশী প্রযুক্তি, আন্তজার্তিক বাজার এবং বাড়তি অর্থায়নের দিকে যাতে উদ্যোগগুলোর আকার বড় হয়। হংকংয়ের নিজস্ব সুবিধাগুলোর সাথে সংযুক্ত হওয়া যেমন: মূলধন এবং তথ্যের অবাধ ব্যবহার যার দ্বারা সেখানকার প্রযুক্তিবিদ এবং  বিনিয়োগকারীরা অঞ্চলভিত্তিকভাবে শক্ত অবস্থানে রয়েছে । এটাকে চীন কাজে লাগাতে চায় মূলত মূল ভুখন্ডের বিকাশমান চাহিদা মেটাতে। আর এটা সৃষ্টি হয়েছে প্রযুক্তি-উদ্যোগ থেকে।

‘উদ্ভাবক জাতি’ হয়ে ওঠা

1455775496174_eTechnopreneurship1-p3_473368অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে চীন এখন ‘উদ্ভাবন’ এর দিকে নজর দিচ্ছে যা তাদের দীর্ঘমেয়াদী কৌশলের অংশ। ‘উদ্ভাবন’কে দেখা হয় দেশের শিল্প-কারখানার রূপান্তর এবং উন্নত করার একটি অন্যতম রাস্তা হিসেবে।  তাই চীনা ব্যবসায় এবং ব্যাক্তিদেরকে সক্রিয়ভাবে উৎসাহিত করা হচ্ছে উদ্ভাবনী ক্ষমতা দিয়ে নিজেদেরকে নতুন করে আবিষ্কার করতে যা তাদের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে নতুন মাত্রা যোগ করবে।

তাদের বিভিন্ন কমিউনিটি যেমন তরুণ, উদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারীরা অনুপ্রেরণা পাচ্ছে আলিবাবা (Alibaba) টেনসেন্ট (Tencent) এর মতো টেকনোলজি জায়ান্টদের সাফল্য দেখে। ব্যবসায়িক পরিবেশ উদার হওয়ায় প্রযুক্তিগত ব্যবসায়িক উদ্যোগ এবং উদ্যোক্তাদের সংখ্যা চীনে গত কয়েক বছর ধরে হু হু করে বেড়ে চলেছে।

সাম্প্রতিক কিছু সরকারী পদক্ষেপ নতুন কিছু উদ্ভাবনের এই ধারার স্বপক্ষে সহায়তা দিচ্ছে। গ্রীষ্মকালীন ডেবস ফোরামে চীনা প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং প্রাতিষ্ঠানিক উদ্ভাবনের পাশাপাশি বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি ক্ষেত্রে নতুনত্ব আনার পরামর্শ দিয়েছেন। চীন সরকারের কার্যক্রমের একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালের মার্চ মাসে। সেখানে সরকার উৎসাহিত করছে, ‘জনগণের মাধ্যমে একটি নতুন ধরনের উদ্ভাবন এবং সবার জন্য উদ্ভাবন’ যা প্রবৃদ্ধিতে নতুন উদ্দীপনা আনবে।

কমিউনিস্ট পার্টির ১৮তম কেন্দ্রীয় কমিটির অক্টোবর, ২০১৫ তে প্রস্তাবনা পাস করে। ১৩তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়  তারা জোর দেয় উদ্যোগের অগ্রগতির উপর, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনে উত্সাহিত করে এবং নতুন শিল্পের বিকাশের ওপর অতিরিক্ত জোর দেওয়ার কথা বলে। এতে করে অর্থনীতি নতুন প্রাণশক্তিতে উদ্বুদ্ধ হবে বলে তাদের ধারনা।

State Administration for Industry and Commerce (SAIC) প্রকাশ করেছে যে, ২০১৫ সালের জানুয়ারী থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে নতুন নিবন্ধিত উদ্যোগের সংখ্যা ৩ দশমিক ১৬ মিলিয়ন থেকে বেড়েছে ১৯ দশমিক ৩ শতাংশ। লক্ষ্যনীয় ব্যাপার হচ্ছে ২০১৪ সালে তথ্য প্রচার, সফটওয়্যার, আইটি সেবা খাতে নতুন সেট-আপ এর নিবন্ধন ১ লাখ ৪৬ হাজার ৭০০ থেকে ৯৭.৮ শতাংশ বেড়েছে। বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং প্রযুক্তি-সেবা বেড়েছে ২ লাখ ৬২ হাজার ৬০০ থেকে ৭০.৩ শতাংশ।

এই উন্নতির তথ্যগুলো লন্ডনের হিসাব এবং পরামর্শভিত্তিক ফার্ম ইউ.এইচ.আই ইন্টারন্যাশনাল (UHI INTERNATIONAL) ২০১৫ সালের নভেম্বরে একটি জরিপের সাথেও সংগতিপূর্ন। ইউ.এইচ.আই এর মতে, ২০১৪ সালে চীনে যতগুলো নতুন কোম্পানি গঠিত হয়েছে তার পরিমাণ ২০১০ সালের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ । ফলে চীনে নতুন ব্যবসায় গঠনের গতির সাথে বিশ্বের বাকি দেশগুলো তাল মিলাতে না পেরে পিছনে পড়ে যাচ্ছে।

চীনে প্রযুক্তি-উদ্যোগের সম্ভাবনা

সরকার সেখানে অভূতপূর্ব কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। অগ্রসরমান ইন্টারনেট এপ্লিকেশন সুবিধা, উন্নয়ন চাকা হিসেবে প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনে গুরুত্ব এবং মূলধন যোগান দেয়াসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভর্তুকিও দিচ্ছে সরকার। এমনকি, স্থানীয় সরকার, ইন্সটিটিউট, বেসরকারী সংস্থা সহযোগিতা এবং উৎসাহিত করছে ইনকিউবেটর, এক্সিলেটর এবং কাজের জায়গা গঠন  যা নতুন টেকনোলজিক্যাল স্টার্টআপ উন্নয়নে সহায়তা করবে। মূলত, প্রযুক্তি-উদ্যোগের প্রচারণার ওপরই জোর দেয়া হচ্ছে সেখানে ।

১২তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০১১-২০১৫) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আশা করেছিল প্রযুক্তি-উদ্যোগী ইনকিউবেটরের সংখ্যা ৮৯৬ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে সেটাকে ১৫০০ তে উন্নীত হবে। ইনকিউবেটরগুলোর কাজ হচ্ছে মূলত নতুন স্টার্ট-আপগুলোকে বিভিন্ন তথ্য এবং দিক নির্দেশনা দেওয়া। যাদেরকে এই তথ্য এবং দিক নির্দেশনাগুলো দেয়া হয় তাদেরকে বলা হয় ইনকিউবেটিজ। প্রাথমিক ধারনাকে ছাড়িয়ে ২০১৪ সালের শেষদিকে এসেই স্বীকৃত ইনকিউবেটরের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৭০০ তে।

নিচের তথ্য-অনুযায়ী স্বীকৃত ইনকিউবেটরের সংখ্যা ১৪৬৮ টি যারা ৭৭৬৭৭ জন ইনকিউবেটিজকে জায়গা করে দিয়েছে। এর মানে হচ্ছে গড়ে প্রতিটি ইনকিউবেটরে স্থান হয় ৫৩ জন ইনকিউবেটিজ এর। চিত্রে উদ্যোক্তাদের মূলধনের হিসাব এবং সরকারের ভর্তুকির পরিমান দেখানো হলো:

প্রযুক্তি-উদ্যোগে ঝুঁকি, তবুও…

প্রযুক্তিগত উদ্যোগে প্রচুর ব্যবসায়িক ঝুঁকি থাকে। ইনকিউবেটরগুলো ‘HKTDC Research’কে বলেছে ইনকিবেটিজদের নিয়োগের সময় ১৫০/২০০ জনের মধ্যে পরবর্তী ধাপে সুযোগ পায় মাত্র ২০/৩০ জন প্রতিযোগী। কিছু উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানকে তিন মাস পরই ছেড়ে দিতে বলা হয় যদি তারা ইনকিউবেটরকে উন্নতি দেখাতে না পারে এবং কোনো বিনিয়োগকারীকে আকর্ষণ করতে না পারে। এই ব্যবসায়গুলোর মধ্যে বেশিরভাগেরই অবস্থা খুবই ক্ষনস্থায়ী, যদিও এর মধ্যে কিছুসংখ্যক টিকে থাকে অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের মধ্যেও।

1455759329749_eTechnopreneurship1-c3_473368কিছুকাল অতিবাহিত করা অভিজ্ঞ কিছু উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান  ‘HKTDC Research’কে জানিয়েছে, তাদের উদ্যোগের মূল্য ১০০ মিলিয়ন চীনা মুদ্রা ছাড়িয়ে গেছে মাত্র ১৮-২৪ মাসের মধ্যেই। এই কারণেই ঝুঁকি থাকা স্বত্তেও বিনিয়োগকারীরা এই দিকে বেশি ঝুঁকছে। উদ্যোগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পাচ্ছে আইটি কিংবা প্রযুক্তি সম্পর্কিত আইডিয়াগুলোই।

আলি রিসার্চের মতে, ২০১৪ সালে মোবাইল ইন্টারনেটভিত্তিক নতুন উদ্যোগের সংখ্যা ছিল ৩২০০’র মতো। এই ধরনের প্রযুক্তিগত উদ্যোগগুলো বেইজিং, সাংহাইয়ের মতো বড় বড় শহরগুলোর দিকেই নজর দিচ্ছে। এদের মুল লক্ষ্য হচ্ছে এফ-কমার্স, এন্টারপ্রাইজ সেবা, গেমস এবং এনিমেশন,সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইত্যাদি নিয়ে কাজ করা। আলি রিসার্চ বলছে, নতুন উদ্যোগগুলো ২৪ মাসের মধ্যেই সাধারণত সাফল্যের মুখ দেখে, অন্যথায় তারা ব্যার্থ হয়।

বিনিয়োগকারীদের প্রলুব্ধ করতে প্রযুক্তি উদ্যোক্তাদেরকে অবশ্যই তাদের দক্ষতা এবং টেকনোলজি-জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে পরিকল্পনাকে লাভজনক ব্যবসায় হিসেবে দেখাতে হবে। এই কারণেই প্রযুক্তি-উদ্যোক্তারা ইনকিউবেটর অথবা পরামর্শকদের সাহায্য চায় যাতে এরা সঠিক পথে ব্যবসায়কে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। বিনিয়োগকারীদের সহায়তা চায় যাতে ব্যবসায়কে দাঁড় করাতে পারে।

এই চাহিদা মোতাবেক, প্রযুক্তিনির্ভর প্রতিষ্ঠান এবং বিনিয়োগকারীরা যৌথভাবে কিছু ব্যবসায় উদ্যোগকে সহায়তা করছে অর্থনোইতিক এবং প্রযুক্তিগত সুবিধা দিয়ে। উদাহরনস্বরুপ, ক্লাউড কম্পিউটিং দৈত্য আলিবাবা গ্রুপের aliyun.com, উন্নত উৎপাদনকারী Foxconn এবং অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান ‘Zhejiang Yinxinggu Capital’ ক্লাউড টাউনের সাথে একসাথে ‘Hangzhou government’ গঠন  করে। তারা উদ্ভাবনী ফ্ল্যাটফর্ম প্রতিষ্ঠা করে প্রযুক্তিগত উদ্যোগগুলোকে সহায়তার জন্য।

হংকংয়ের অন্তর্ভুক্তি

অনেক প্রযুক্তি-উদ্যোগ নির্ভর ব্যবসায়গুলো হংকংয়ের সাথে সংযুক্ত হওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী। মূলত,  অঞ্চলভিত্তিক প্রযুক্তিগত অংশীদারিত্ব এবং পেশাদারদের কাছে পৌঁছাতে তাদের কেঊ কেউ বিশেষভাবে তৎপর। এর কারণ এই স্টার্ট-আপ গুলোকে সহযোগিতা করার সামর্থ্য হংকংয়ের রয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় তাদের শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে যেমন: সিস্টেম এর ইন্টিগ্রেশন এবং এপ্লিকেশন, ব্যবসায় বাজারজাতকরনের ব্যবস্থাপনা, অর্থ এবং অন্যান্য পেশাদার সেবাগুলো। এই গুলোকে কাজে লাগিয়ে বিশাল ব্যবসায় করার সুযোগ রয়েছে সেখানে। হংকংয়ের মাধ্যমে চীন নিজেদেরকে প্রকাশ এবং প্রবেশাধিকার পেতে সক্ষম হবে যা প্রযুক্তিতে আন্তজার্তিক মানে যেতে তাদের সহায়তা করবে।

সূত্র : হংকং ট্রেড ডেভলপমেন্ট কাউন্সিলের (এইচকেটিডিসি) ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

Sharing is caring!

Leave a Comment