ছেলের উৎসাহে বাবার ‘ফিস কাবাব’

ছেলের উৎসাহে বাবার ‘ফিস কাবাব’

  • আতিকুর রহমান

খুলনায় একটি হোটেল আছে, নাম-আল-জামিল হোটেল। রূপসা সেতু থেকে ফুলতলার দিকে চলে যাওয়া আড়ংঘাটা বাইপাস সড়কের পাশেই ছোট্ট ছিমছাম একটি হোটেল। এর মালিক জামিল আহমেদের জীবনের গল্পের পরতে পরতে রয়েছে কাবাবের সুঘ্রাণ। যে সে কাবাব নয়, ফিস কাবাব। ২৭ বছরে ভিনদেশে কয়লা পুড়িয়ে যা কিছু শিখেছেন, তার সবই এখন ঢেলে দিচ্ছেন এ ‘শিল্পে’।

মাছের কাবাব বানানোটা পশ্চাশোর্ধ জামিল আহমেদের কাছে একটা শিল্পই বটে। চিকেন, বিফ কিংবা মাটনের গ্রিল— সবকিছুতেই হাতের দক্ষতা থাকলেও ফিশ কাবাব তৈরিই তিনি বেশি উপভোগ করেন। ফিশ কাবাব বানানোর কাজ ব্যবসার চেয়েও এখন বড় হয়ে উঠেছে তার  কাছে। কাবাবের স্বাদে কীভাবে আরেকটু নতুনত্ব আনা যায়, চুলোয় প্রতিটি শিক ওঠানোর আগে কথাটি ভাবেন জামিল। চিন্তা করেন, কেমন করে দূর থেকে বহুদূরে সবার মাঝে ফিশ কাবাবের সুঘ্রাণ আরও ব্যপকহারে ছড়িয়ে দেওয়া যায়।

বিদেশ থেকে ফেরার পর দুই বন্ধু আসলাম ও শাহীনের উৎসাহে বেশ কয়েক মাস আগে একটা সাধারণ রেস্তোরা দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন জামিল। কিন্তু এতেকরে কিছুতেই যেন মন ভরছিল না তার। পেশা হিসেবে এমন কিছু বেছে নিতে  চাচ্ছিলেন, যেটা হবে অন্য সবার থেকে আলাদা। পথ খুলে দিল তাঁর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ছেলে।

বন্ধুদের সাথে আড্ডায় একদিন সে বলে ফেলল, আব্বু খুব ভালো ফিশ কাবাব বানাতে পারেন। সাথে সাথে সবাইকে কাবাব খাওয়ার দাওয়াতও দিয়ে এল সে। কথাটা বাবাকে এসে সে জানাল, কিন্তু বাড়িতে তখন গ্রিল করার চুলো নেই। কিন্তু বন্ধুদের কাছে ছেলের তো মান রাখতেই হবে, তাই জামিল আহমেদ বাজারে গিয়ে দোকান থেকে বড় একটা চুলো বানিয়ে আনলেন। সেটা দিয়ে খুব ভালো ভাবেই অতিথি আপ্যায়ন করা হলো।

তৈরি হচ্ছে ফিস কাবাব
তৈরি হচ্ছে ফিস কাবাব

এর বেশ কিছুদিন পর জামিলের ছেলে বলল, বাবা! চুলোটাকে ফেলে না রেখে এটা দিয়ে আমাদের হোটেলে সামুদ্রিক মাছের কাবাব বানানো শুরু করলে কেমন হয়? প্রথমে জামিল আপত্তি করেছিল। বরলেন, ‘বাবারে…২৫-৩০ বছর তো শুধু আগুনই গুঁতোলাম। আর কত!’ কিন্তু পরক্ষণেই ভেবে দেখলেন ব্যতিক্রম কিছু করার একটা ভালো সুযোগ এসেছে! যেটা আগে থেকে মনের মধ্যে লালন করে আসছিলেন। আজকে পুরোনো সেই নেশাটা নতুন করে আবার ছেলের উৎসাহে জেগে উঠল।

সেই থেকেই শুরু “আল-জামিল হোটেল” যা কিনা শুধুই ফিশ কাবাবের দোকান। অল্প কয়দিনেই খুলনা মহানগরে এর সুনাম আর সুবাস ছড়িয়ে পড়ে। জামিলের ফিশ কাবাবের স্বাদ নিতে খুলনায় মাশরাফি-সাকিবসহ জাতীয় দলের আরও কয়েকজন ক্রিকেটার গিয়েছিলেন।

জামিল আহমেদের জন্ম বরিশালের কাউনিয়াতে, যদিও তাদের পৈতৃক নিবাস ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার তারাবুনিয়া গ্রামে। ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়ে অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়েন জামিল। এরপর চাকরির খোঁজে ঢাকায় আসেন। বছর সাতেক বিভিন্ন পরিচালকের সাথে সহকারী হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু এতে করে জামিলের মনে হলো এভাবে চলতে থাকলে ভাগ্য বদলানো যাবেনা। তাই জীবিকার সন্ধানে ১৯৯০ সালে দুই বন্ধুকে সাথে নিয়ে হংকংয়ে পাড়ি জমান। তখন জামিলের বয়স ছিল ২৫ কি ২৬ বছর।

কিন্তু কিছুতেই যেন পেরে উঠতে পারছিলেন না জামিল। একদিন হংকংয়ের নাথান রোডে কোনো এক ঘটনাচক্রে ওজি নামে  লেবাননের এক নাগরিকের সাথে কথা হয় তার। ওজির হাত ধরেই সেখানকার এক রেস্তোরাঁয় চাকরি এবং তার কাছেই ফিশ কাবাব বানানোর দীক্ষা নেন জামিল। এরপর হংকং ছেড়ে জামিল সৌদি আরবে যান। এবং সৌদি আরবে গিয়ে ওই অঞ্চলে ফিশ কাবাব জনপ্রিয় করতে থাকেন।’

জামিলের সেই চেষ্টাটা এখনও অব্যাহত রয়েছে তার মাতৃভূমি বাংলাদেশে। জামিলের প্রত্যাশা, তার  ফিশ কাবাব হয়তো একদিন খুলনার নামকরা ‘ব্র্যান্ড হয়ে উঠবে।’favicon59

Sharing is caring!

Leave a Comment