সাংবাদিক থেকে উদ্যোক্তা

সাংবাদিক থেকে উদ্যোক্তা

  • লিডারশিপ ডেস্ক

জীবন বাঁক বদলায় অবিরাম। সেই বাঁক বদল কখনো বিপদ ডেকে আনে, আবার কখনো কখনো বয়ে আনে সৌভাগ্য। এ গল্পটি একজন উদ্যোক্তার। তিনি তাসলিমা মিজি। সাংবাদিকতার পেশা ছেড়ে হয়ে উঠেছেন পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী। তার গল্পটি অনেকের জন্যই অনুপ্রেরণার।


‘নারী উদ্যোক্তা’ শব্দটিতে তার প্রবল আপত্তি। তার কথা হচ্ছে ‘উদ্যোক্তা’ তো উদ্যোক্তাই। হোক সে নারী অথবা পুরুষ। তাই নারী উদ্যোক্তা পরিচয়ে আলাদা প্রাধান্য পাওয়ার কোনো ইচ্ছা তার নেই। নিজের বিনয় অথবা ব্যক্তিগত দর্শনের কারণে এতে তার আপত্তি থাকলেও আমাদের সামাজিক পারিপার্শ্বিকতাকে হয়তো অস্বীকার করতে পারবেন না তিনিও। চার দেয়ালের বাইরের জীবনে নারীরা এখনো পিছিয়ে। অনেকে সেই দেয়াল গুঁড়িয়ে দিয়ে বিশ্বজয় করছেন। আমাদের সমাজেও এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। তাসলিমা মিজি তাদেরই একজন।

সাংবাদিকতার চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি এখন সফল ব্যবসায়ী। একাধারে দুটি প্রতিষ্ঠানের সিইও। ‘গুটিপা’ এবং কম্পিউটার সোর্স ‘টেকম্যানিয়া’ শীর্ষক দুটি প্রতিষ্ঠান সফলভাবে চালিয়ে আসছেন তিনি। নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেওয়া তাসলিমা ইচ্ছাডানায় ভর করে আস্তে আস্তে নিজের স্বপ্নগুলোকে বিকশিত করতে চান।

ছেলেবেলা থেকেই তাসলিমা ছিলেন ডানপিটে স্বভাবের। বাঁধনহারা স্বাধীন পাখির মতো চলাচলে অভ্যস্ত। চাঁদপুরের শাহরাস্তির মেয়ে তাসলিমা এসএসসি শেষ করেন নিজ গ্রামে। এরপর থেকেই ইট পাথরের শহুরে জীবনের শুরু। পড়াশোনার জন্য চলে আসেন ঢাকায়। বাবা ঢাকায় ব্যবসা করতেন আর মা ছিলেন গৃহিণী।

indexছয় ভাইবোনের সংসারে শৈশবের পুরোটা কেটেছে আনন্দে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৬ সালে সমাজবিজ্ঞানের ওপর মাস্টার্স শেষ করেন। পড়াশানার পাশাপাশি করেছেন সাংবাদিকতা। ১৯৯৮ সালে ভোরের কাগজ এবং জনকণ্ঠ পত্রিকাতে সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর কেটে যায় কয়েক বছর। ২০০১ সালে প্রথম আলো পত্রিকায় স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর নানা চড়াই উত্রাই পেরিয়ে অনুভব করলেন চাকরি-বাকরি তাকে দিয়ে হবে না। এরপর থেকেই ব্যবসায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ততা। অভিজ্ঞতার ঝুলি যখন কানায় কানায় পূর্ণ, তখনই এ বছরের শুরুর দিকে শুরু করেন ‘গুটিপা’। এর আগে অবশ্য সাত-আট বছর ধরে কম্পিউটার ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত তিনি। কম্পিউটার ব্যবসায়ের ইনপোর্ট ডিস্ট্রিবিউশনের মাধ্যমে বা বিভিন্ন ডিলারের মাধ্যমে কাস্টমারের কাছে পৌঁছে দেওয়া হতো। পুরো প্রক্রিয়াটি কো-অর্ডিনেট করতেন তিনি। কিন্তু তার মনের ভিতর ইচ্ছে ছিল উৎপাদন প্রক্রিয়ার যুক্ত থাকা।

সেখান থেকেই লেদারিনার ব্যানারে শুরু করেন ব্যবসা। মূলত তিনি লেদার এবং আর্টিফিসিয়াল লেদার নিয়ে কাজ করে থাকেন। সরাসরি ট্যানারির সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও লেদারেনিয়ার ব্যানারে নিজেই প্রতিষ্ঠিত করেছেন ‘গুটিপা’ লেদার শপ। পণ্য বানিয়ে ক্রেতার গোড়ায় পৌঁছে দেওয়াই হলো তার কাজ। নিজের অতীতে কোনো একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড না থাকলেও লেদারের প্রোডাক্ট তৈরিতে নিজেই ডিজাইন শুরু বরলেন। ফেসবুক পেজের মাধ্যমে শুরু হলো ব্র্যান্ডকে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়াস। শুরু থেকেই খুব সাড়া পান তিনি। ফেসবুকের মাধ্যমে পণ্য বিক্রিও বাড়তে থাকে। এখন তার কাজ দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে সমাদৃত হচ্ছে বিদেশেও।

এ প্রসঙ্গে তাসলিমা মিজি বলেন— ‘আমার পণ্য তরুণদের বেশি পছন্দের। তা ছাড়া এসবের প্রচারণা অনলাইনভিত্তিক হওয়াতে তরুণরাই বেশি আকৃষ্ট হয়।

একটু ফ্যাশনেবল প্রোডাক্ট হওয়ায় সবাইকে সহজেই আকর্ষণ করে। ’

অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যবসায়ে সাফল্যের মুখ দেখা তাসলিমার লেদারের সোর্স মূলত, লোকাল ট্যানারি। মজার ব্যাপার হলো ট্যানারি শিল্পে মূলত পুরুষরাই বেশি জড়িত। গুটি কয়েক নারী থাকলেও তেমন সক্রিয় নন। এ ক্ষেত্রে একবারে ব্যতিক্রম তাসলিমা। তার অধীনে অনেক নারী কর্মীও রয়েছে। এই কাজ করতে গিয়ে বিব্রতও হতে হয়ে অনেক। তাসলিমার ভাষায়— ‘আসলে পুরো প্রক্রিয়াটাই অনেক চ্যালেঞ্জিং। এখানে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। কেন আসলাম, এখানে কী করছি, কোনো একটা মেয়ে হয়ে এসব করতে হচ্ছে, বাড়িতে কী কোনো পুরুষ নেই ইত্যাদি ইত্যাদি হাজারটা প্রশ্ন। এমনিতে একটি প্রোডাক্ট তৈরির অনেকগুলো ধাপ রয়েছে। মার্কেট সোর্স থেকে সংগ্রহ করা, থ্রেড আছে। সুতা আছে, গ্লু আছে। বিভিন্ন ধরনের লাইনিং, বিভিন্ন ধরনের কাভারিং রয়েছে। কালার রয়েছে। এই পুরো প্রসেসটি মূলত পুরুষদের পদচারণা বেশি। সে জায়গাটার পরিবর্তন হয়ে মেয়েরাও আজকাল অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। কমবেশি অসুবিধে তো হয়ই। ’

সরকারি উদ্যোগের বিষয়ে তাসলিমা বলেন, সরকার মেয়েদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করতে চায়। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিভিন্ন ব্যাংকে অনেক লোন দেয়। আমাদের মতো, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য সরকারি উদ্যোগ রয়েছে কিন্তু এগুলো এখন সহজলভ্য নয়। এসবের মধ্যে রয়েছে অনেক চ্যালেঞ্জ, কারণ কোনো ব্যাংক বা কোনো অর্থ সংস্থা যখন আমরা আবেদন করলে অনেক সময়ের প্রয়োজন হয়। তা ছাড়া একজন নারীর হাতে তাদের ইনভেস্টমেন্টকে কেউই নিরাপদ ভাবতে পারে না।

এ ধরনের ব্যবসায় আসতে চাইলে দুটো বিষয়ের ওপর জোর দেওয়ার কথা বলেন তাসলিমা। ‘লেদার গুডস প্রোডাকশন আর মার্কেটিং দুটোই আলাদা বিষয়। আবার একটি ছাড়া আরেকটি চলবে না। একজন উদ্যোক্তাকে সে সম্পর্কে পুরো ধারণা রাখতে হবে। নতুন কোনো নারী যদি এই প্রফেশনে কাজ করতে চায় তবে তাকে প্রোডাক্ট এবং মার্কেট সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা নিয়ে কাজ করা উচিত। ’

তিনি আরও যোগ করেন যদি লেদার সম্পর্কে আইডিয়া না থাকে তবে সে ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।

তাসলিমা মিজির প্রতিষ্ঠান থেকে তরুণ-তরুণী উভয়ের জন্যই প্রোডাক্ট তৈরি হয়। উল্লেখযোগ্য পণ্যের মধ্যে রয়েছে ওয়ালেট, ক্রস বডি ব্যাগ, হোগ ব্যাগ, টোড ব্যাগ, ফ্যাশন ব্যাগ, অ্যাসেনশিয়াল ব্যাগ, নানা ধরনের রিসলেট, মোবাইল ওয়ালেট, কার্ড হোল্ডার, কিউরিন, ট্রাভেল ব্যাগ, ফ্লিপ ফ্লপ সেন্ডেল ইত্যাদি।

ব্যক্তিগত জীবনে এক ছেলে নিয়ে তার সুখের সংসার।   একটু স্টাইলিস ক্যাজুয়াল লাইফ পছন্দ তার। চেষ্টা করেন সারা দিনের কাজগুলো নিজেই গুছিয়ে করার চেষ্টা করি। অ্যালিফ্যান্ট রোডের টেকম্যানিয়ার সিইও হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি নিজের ব্যবসাটাও চালিয়ে যাচ্ছেন। ব্যবসায়ের দৌড়ঝাঁপে খুব বেশি সময় হয়ে ওঠে না। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে একটু পড়াশোনা কিংবা টিভি দেখাটাই রুটিন।

তাসলিমা শাড়ি পড়তে খুব পছন্দ করেন কিন্তু শাড়ি পরা হয়ে ওঠে না। প্যান্ট, টি-শার্ট আর ফতুয়া পড়তেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। সাজগোজ আর রূপচর্চার খুব একটা করা হয়ে ওঠে না তার। যদিওবা শখ হয় সে ক্ষেত্রেও একেবারেই হালকা সাজ তার বেশি পছন্দ। তাসলিমা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে পছন্দ করেন। নিজের ঘর-সংসার নিজেই গুছিয়ে রাখেন। অন্যান্য শখের মধ্যে বই পড়াটাকেই সবচেয়ে বেশি উপভোগ করেন। ভালো মানের মুভি হলে দেখেন অন্যথায় দেখা হয় না। তার সবচেয়ে বড় স্বপ্ন উদ্যোক্তা হিসেবে সাফল্যের শীর্ষে ওঠা। নিজের ব্র্যান্ডটাকে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলেও পরিচিত করে তোলা। তাসলিমার সে স্বপ্ন খুব দ্রুতই পূরণ হবে এমন প্রত্যাশা আমাদের সবার।favicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment