একটি শিশু, একজন শিক্ষক, একটি কলম আর একটি বই বিশ্বকে বদলে দিতে পারে: মালালা ইউসুফজাই

একটি শিশু, একজন শিক্ষক, একটি কলম আর একটি বই বিশ্বকে বদলে দিতে পারে: মালালা ইউসুফজাই

২০১৩ সালের ১২ই জুলাই প্রথমবারের মত জাতিসংঘের সাধারন সভা বা জেনারেল অ্যাসেম্বলির প্রেসিডেন্টের তত্ত্বাবধানে তরুণদের নিয়ে জাতিসংঘ আয়োজন করে “দ্যা গ্লোবাল ইউথ টেকওভার”। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আসা তরুণের সাথে ওই কনভেনশানে যোগ দেন তালেবানের হাতে গুলিবিদ্ধ হওয়া শান্তিতে নোবেল বিজয়ী পাকিস্তানের শিক্ষাসংগ্রামী মালালা ইউসুফজাই। কনভেনশানে দেওয়া তাঁর অনুপ্রেরণাদায়ী বক্তব্যটি দি প্রমিনেন্ট পাঠকের জন্য প্রকাশিত হলো:


মালালা ইউসুফজাই: পরম দয়ালু ও ক্ষমাশীল সৃষ্টিকর্তার নামে। জাতিসংঘের সম্মানিত মহাসচিব জনাব বান কি-মুন, সাধারন সভার সম্মানিত প্রেসিডেন্ট ভুক জেরেমিক, বিশ্বশিক্ষা বিষয়ক জাতিসংঘের সম্মানিত দূত জনাব গর্ডন ব্রাউন, শ্রদ্ধেয় বয়জোষ্ঠ এবং আমার প্রিয় ভাই ও বোনেরা;

আজ অনেক দিন পর আবার কথা বলতে পেরে সম্মানিত বোধ করছি। এখানে এত গন্যমান্য মানুষের ভিড়ে থাকতে পারাটা আমার জীবনের অন্যতম সেরা মুহূর্ত। কোথা থেকে শুরু করবো জানিনা। আমি জানিনা সবাই আমার কাছ থেকে ঠিক কি আশা করছেন। তবে সর্বপ্রথম ধন্যবাদ সৃষ্টিকর্তাকে, যার কাছে আমরা সবাই সমান আর ধন্যবাদ সেই মানুষগুলোকেও যারা আমার আরোগ্য আর নতুন জীবনের জন্যে প্রার্থনা করেছেন। ঠিক বিশ্বাস হতে চায়না মানুষ আমাকে এতটা ভালোবেসেছে! পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে হাজার হাজার কার্ড আর উপহার পেয়েছি আমি। তাদের সবাইকে ধন্যবাদ। সেসব শিশুদেরকে ধন্যবাদ যাদের নিষ্পাপ কথা আমাকে উৎসাহ জুগিয়েছে। বড়দেরকেও ধন্যবাদ দিতে চাই যাদের প্রার্থনা আমাকে দিয়েছে শক্তি।

আমাকে সেরে উঠতে আর শক্তি ফিরে পেতে সাহায্য করার জন্যে পাকিস্তান ও ব্রিটেনের হাসপাতালের সমস্ত চিকিৎসক, সেবিকা আর কর্মচারীদের এবং ইউএই সরকারকেও ধন্যবাদ জানাই। বিশ্বশিক্ষার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের বিশেষ দূত জনাব গর্ডন ব্রাউনের কাজ ও জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি-মুনের পদক্ষেপকে পুরোপুরি সমর্থন করি আমি। আর তাদের ক্রমাগত নেতৃত্বের জন্যেও দুজনকেই ধন্যবাদ জানাই।

এটা আমি নবী মোহাম্মদ (সঃ), যিশু খ্রিষ্ট এবং গৌতম বুদ্ধের কাছ থেকেই শিখেছি। আর পরবর্তিতে উত্তরাধিকারের মত এই ধারা আমি অর্জন এবং বহন করেছি মার্টিন লুথার কিং, নেলসন ম্যান্ডেলা আর মুহাম্দ আলি জিন্নাহের কাছ থেকে। এটা সেই অহিংসার দর্শন, যা আমি শিখেছি গান্ধিজি, বাচা খান এবং মাদার তেরেসার কাছ থেকে। এটা সেই ক্ষমাশীলতা যা আমি শিখেছি আমার বাবা আর মায়ের কাছ থেকে। শান্তিতে থাকা আর সবাইকে ভালোবাসা – এটাই আমার আত্মা আমাকে সবসময় বলে।

মালালা দিবস শুধু আমার দিন নয়। এ দিনটি প্রত্যেকটি নারী, ছেলে ও মেয়ের – যারা নিজেদের অধিকারের জন্যে সোচ্চার হয়েছে। এমন হাজার হাজার মানবাধিকার কর্মী ও সমাজকর্মী রয়েছেন যারা কেবল মানবাধিকারের জন্যই নয়, ক্রমাগত শিক্ষা, শান্তি ও সাম্য প্রতিষ্ঠায় নিজেদের লক্ষ্য অর্জনের জন্যে কাজ করে চলেছেন। হাজার হাজার মানুষ সন্ত্রাসীদের দ্বারা নিহত আর লাখ লাখ মানুষ আহত হয়েছেন। আমি তাদেরই একজন।

তাই আমি এখানে দাড়িয়েছি… অনেকের ভেতরে একজন হয়ে। আমি বলছি – তবে কেবল আমার জন্য নয়, বরং সকল ছেলে – মেয়ের জন্যে। আমি সোচ্চার হয়েছি – তবে কেবল নিজের কথা বলতে নয়, বরং এজন্য যাতে অন্যদের কথাও শুনতে পারা যায়। যারা নিজেদের অধিকারের জন্যে লড়েছেন :
শান্তিতে বাস করবার জন্যে
মর্যাদাপূর্ণ ব্যবহারের জন্যে
সুযোগের সাম্যবস্থার জন্যে
শিক্ষিত হওয়ার জন্যে।

প্রিয় বন্ধুরা, ২০১২ সালের ৯ অক্টোবর তালেবানরা আমার কপালের বামপাশে গুলি করে। আমার বন্ধুদেরকেও রেহায় দেয়নি। ওরা ভেবেছিল গুলি আমাদেরকে চুপ করিয়ে দেবে। কিন্তু ওরা ব্যর্থ হয়েছে। এবং এরপর, সেই নিরবতার ভেতর দিয়েই এসেছে হাজারো কন্ঠ। সন্ত্রাসীরা ভেবেছিল আমাদের লক্ষ্য আর আশাকে বদলে দিতে পারবে। কিন্তু নিজের ভেতরের দূর্বলতা, ভয় আর প্রত্যাশাহীনতা মরে যাওয়া ছাড়া আমার জীবনে আর কোন পরিবর্তনই আসেনি। বরং শক্তি, সামর্থ্য আর সাহস জন্ম নিয়েছিল। আমি সেই একই মালালা আছি। আমার প্রত্যাশাও সেই একই আছে। এক আছে আশা। এক আছে আমার স্বপ্নও।

প্রিয় ভাই ও বোনেরা, আমি কারো বিরুদ্ধে নই। আমি এখানে তালেবান বা কোন সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে নিজের ব্যাক্তিগত প্রতিশোধের জায়গা থেকেও আসিনি। আমি এখানে এসেছি প্রতিটি শিশুর শিক্ষার অধিকার নিয়ে কথা বলতে। আমি সমস্ত উগ্রপন্তী, বিশেষ করে সকল তালেবানের ছেলে-মেয়েদের জন্য শিক্ষা চাই।

আমি এমনকি আমাকে গুলিবিদ্ধ করা তালেবানকে ঘৃণাও করিনা! এমনকি যদি আমার হাতে একটি বন্দুক থাকে আর সে আমার সামনে দাড়ায়, আমি তাকে গুলি করব না। এটা আমি নবী মোহাম্মদ (সঃ), যিশু খ্রিষ্ট এবং গৌতম বুদ্ধের কাছ থেকেই শিখেছি। আর পরবর্তিতে উত্তরাধিকারের মত এই ধারা আমি অর্জন এবং বহন করেছি মার্টিন লুথার কিং, নেলসন ম্যান্ডেলা আর মুহাম্দ আলি জিন্নাহের কাছ থেকে। এটা সেই অহিংসার দর্শন, যা আমি শিখেছি গান্ধিজি, বাচা খান এবং মাদার তেরেসার কাছ থেকে। এটা সেই ক্ষমাশীলতা যা আমি শিখেছি আমার বাবা আর মায়ের কাছ থেকে। শান্তিতে থাকা আর সবাইকে ভালোবাসা – এটাই আমার আত্মা আমাকে সবসময় বলে।

প্রিয় ভাই ও বোনেরা, অন্ধকারেই কেবল আলোর গুরুত্ব বুঝি আমরা। নিঃস্তব্ধতার ভেতর দিয়েই বুঝতে পারি কণ্ঠস্বরের গুরুত্ব। ঠিক তেমনি ভাবে উত্তর পাকিস্তানের সোয়াতে থাকার সময় বন্ধুক দেখে আমরা বুঝেছি বই আর কলমের গুরুত্ব।

পৃথিবীর বেশ কিছু অংশে, বিশেষ করে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে সন্ত্রাস, যুদ্ধ ও সংঘাত শিশুদের বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। আমরা সত্যিই এই যুদ্ধ দেখতে দেখতে ক্লান্ত। পৃথিবীর নানা প্রান্তে নানাভাবে নারী আর শিশুরা কষ্ট পাচ্ছে। ভারতে নিষ্পাপ আর দরিদ্র শিশুরা শিশুশ্রমের শিকার হচ্ছে। নাইজেরিয়ার অনেক বিদ্যালয় ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।

জ্ঞানীরা বলেছেন- অসির চাইতে মসি বেশি শক্তিশালি। কথাটা সত্যি। উগ্রপন্থিনা কলম আর বইকে ভয় পায়। শিক্ষার শক্তি আর নারীরা তাদেরকে ভয় পাইয়ে দেয়। নারীদের কন্ঠের শক্তিকে ভয় পায় তারা। আর তাই কিছুদিন আগে কুয়েটাতে ১৪ জন নিষ্পাপ মেডিকেল শিক্ষার্থীকে মেরে ফেলেছে তারা। খাইবার পাখতুন খাওয়াতেও এত নারী শিক্ষক আর পোলিওকর্মীকে মেরে ফেলেছে। কারণ তারা আমাদের সমাজের পরিবর্তন আর সাম্যতাকে সবসময়েই ভয় করে আর এখনো করছে।

মনে পড়ে আমার বিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন – তালেবানরা কেন শিক্ষার বিরুদ্ধে? সে খুব সোজা একটা জবাব দিয়েছিল। সে নিজের বই দেখিয়ে বলেছিল – কারণ একজন তালেবান জানেনা এর ভেতরে কি লেখা আছে।

তারা সৃষ্টিকর্তাকে এতটাই ক্ষুদ্র আর সংকীর্ণ ভাবে যিনি বিদ্যালয়ে যাওয়ার অপরাধে মেয়েদের সোজা দোজখে পাঠিয়ে দেবেন। নিজেদের ব্যাক্তিগত স্বার্থের জন্যে সন্ত্রাসীরা ইসলাম আর পশতুন সমাজকে ব্যবহার করছে কেবল। পাকিস্তান একটি শান্তিপ্রিয় গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র। পশতুনরা নিজেদের ছেলে-মেয়ের জন্যে শিক্ষা চায়। এবং ইসলাম শান্তি, মানবিকতা আর সম্প্রীতির ধর্ম। ইসলাম বলে শিক্ষা কেবল একজন শিশুর অধিকার নয়, তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যও।

সম্মানীয় মহাসচিব, শিক্ষার জন্য শান্তি দরকার। পৃথিবীর বেশ কিছু অংশে, বিশেষ করে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে সন্ত্রাস, যুদ্ধ ও সংঘাত শিশুদের বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। আমরা সত্যিই এই যুদ্ধ দেখতে দেখতে ক্লান্ত। পৃথিবীর নানা প্রান্তে নানাভাবে নারী আর শিশুরা কষ্ট পাচ্ছে। ভারতে নিষ্পাপ আর দরিদ্র শিশুরা শিশুশ্রমের শিকার হচ্ছে। নাইজেরিয়ার অনেক বিদ্যালয় ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। আফগানিস্তানের মানুষেরা যুগ যুগ ধরে উগ্রপন্থীদের ঝামেলা সহ্য করে চলেছে। মেয়ে শিশুদেরকে জোর করে গৃহকাজ কিংবা বিয়ে করতে বাধ্য করা হচ্ছে। দারিদ্রতা, অজ্ঞতা, অবিচার, বর্ণবাদ আর বঞ্চনা প্রতিটি নারী-পুরুষের প্রধান সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে।

সহকর্মীরা, আজ আমি নারী অধিকার আর শিশুশিক্ষার ওপর বেশি জোর দিচ্ছি কারণ তারাই সবচাইতে বেশি দুর্ভোগে রয়েছে। এমন একটা সময় ছিল যখন নারী সমাজকর্মীরা পুরুষদেরকে তাদের কথা বলার জন্যে দাড়াতে বলত। কিন্তু এবার আমরা নিজেদের কথা নিজেরাই বলব। আমি পুরুষদেরকে নারী অধিকারের কথা বলতে নিরুৎসাহিত করছি না বরং চাইছি নারীরা নিজেরাই নিজেদের জন্যে যুদ্ধ করার মত স্বাধীন হয়ে উঠুক।

প্রিয় ভাই ও বোনেরা, কথা বলার এটাই সময়। আর তাই আজ আমি বিশ্বনেতাদেরকে বলব শান্তি আর সমৃদ্ধির পক্ষে নিজেদের কৌশল আর পদ্ধতিকে পরিচালনা করতে। তাদেরকে বলব যে সবধরনের শান্তিচুক্তিতে নারী আর শিশু অধিকারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। নারী মর্যাদা আর অধিকারের বিরুদ্ধে থাকা কোন চুক্তিই গ্রহনযোগ্য নয়। প্রতিটি সরকারকেই বলব প্রত্যেকটি শিশুর জন্যে বাধ্যতামূলক শিক্ষার নিশ্চয়তা রক্ষা করতে। তাদেরকে বলব সন্ত্রাস আর সহিংসতার বিরুদ্ধে লড়তে, হিংস্রতা আর ক্ষতিগ্রস্থতা থেকে শিশুদেরকে রক্ষা করতে। উন্নত দেশগুলোকে বলব উন্নয়নশীল বিশ্বের নারীশিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারনে কাজ করতে। ধর্ম, বর্ণ, জাত, লিঙ্গভিত্তিক সবধরনের অসমতাকে পাশ কাটিয়ে সব সম্প্রদায়কেই আমন্ত্রণ জানাব সহনশীল হতে। নারী উৎকর্ষের জন্যে তাদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে। কারণ অর্ধেক পিছিয়ে পড়া মানুষ নিয়ে আমরা এগোতে পারব না। পৃথিবীর সব বোনকে বলব সাহসী হতে – নিজেদের শক্তি আর সম্ভাবনাকে বুঝতে। প্রিয় ভাই ও বোনেরা, প্রতিটি শিশুর জন্যে আমরা বিদ্যালয় ও শিক্ষা চাই। শান্তি আর শিক্ষার প্রতি আমাদের এই যাত্রা আমরা সবসময়ই চালিয়ে যাব। কেউ আমাদেরকে দমিয়ে রাখতে পারবে না। আমরা আমাদের অধিকারের জন্যে বলব এবং আমাদের কন্ঠ দিয়েই পরিবর্তন আনব। আমাদের কথার শক্তি আর সামর্থ্যে আমাদের বিশ্বাস রাখা উচিত। আমাদের কথা পৃথিবীকে বদলে দিতে পারে। কারণ আমরা সবাই শিক্ষার জন্যে একসাথে আছি। আর তাই যদি লক্ষ্য অর্জন করতে হয় তাহলে আমাদেরকে জ্ঞানের অস্ত্র দিয়ে শক্তিশালী আর একতার মাধ্যমে সুরক্ষিত হতে দিন।

প্রিয় ভাই ও বোনেরা, আমাদের ভুললে চলবে না যে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতিনিয়ত অবিচার, দারিদ্র আর অজ্ঞতায় ভুগছে। আমাদের ভুললে চলবে না যে লক্ষ লক্ষ শিশু বিদ্যালয়ের বাইরে রয়েছে। আমাদের ভুললে চলবে না যে আমাদের ভাই বোনেরা উজ্জ্বল এক ভবিষ্যতের জন্যে অপেক্ষা করছে। আর তাই আসুন বই আর কলম তুলে নিয়ে বিশ্ব নিরক্ষরতা, দারিদ্রতা আর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াই।

একজন শিশু, একজন শিক্ষক, একটি বই আর একটি কলম বিশ্বকে বদলে দিতে পারে। শিক্ষাই একমাত্র সমাধান। শিক্ষাই প্রথম। favicon

Sharing is caring!

Leave a Comment