জীবন একটা প্রিপেইড কার্ড : চেতন ভগত

জীবন একটা প্রিপেইড কার্ড : চেতন ভগত

ভারতের সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক চেতন ভগত। তাঁর উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে বক্সঅফিস তোলপাড় করা চলচ্চিত্র থ্রি ইডিয়টস। চেতন ভগতের জন্ম ভারতের নয়াদিল্লিতে, ১৯৭৪ সালের ২২ এপ্রিল। বই লেখার পাশাপাশি তিনি তরুণদের জন্য উৎসাহমূলক বক্তৃতা করেন। ২০০৮ সালের ২৪ জুলাই পুনের সিমবায়োসিস ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্টের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে চেতন ভগত এই বক্তৃতা দেন। ইংরেজি থেকে ভাষান্তর করেছেন মারুফ ইসলাম


cbint2আজকের এই দিনটা শুধুই তোমাদের। মানুষের জীবনে কিছু কিছু দিন আসে যেদিন তার উচ্ছ্বাসের কোনো কমতি থাকে না। কলেজের প্রথম দিনটিও এমন একটি দিন। আমি জানি, ক্লাসরুমটা কেমন হবে, শিক্ষকেরাই বা কেমন হবেন, ক্লাসের নতুন বন্ধুরা কারা—এমন অসংখ্য প্রশ্ন এখন তোমাদের মনে উঁকি দিচ্ছে। এই উচ্ছ্বাস, এই কৌতূহল তোমাদের ভেতর যেন আগুনের শিখার মতো জ্বলছে। সেই শিখাটি কীভাবে জ্বালিয়ে রাখতে হয়, আজকে আমি তোমাদের তা বলব।

আমাদের বয়স যত বাড়ে, এই অগ্নিশিখাটির দীপ্তি তত কমে আসে। তার বদলে স্থান করে নেয় বিষণ্নতা, উদ্দেশ্যহীনতা আর তিক্ততা। ‘জব উই মেট’ ছবির প্রথম আর দ্বিতীয় অংশের কারিনার মধ্যে কতটা পার্থক্য ছিল মনে আছে? আগুনের শিখা নিভে গেলে ঠিক এমনই হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে এই শিখাটিকে বাঁচিয়ে রাখা যায়। প্রথমত, এর যত্ন নিতে হবে, জ্বলার মতো তেল জোগাতে হবে। দ্বিতীয়ত, ঝোড়ো হাওয়ার সামনে পড়লে আগলে রাখতে হবে।

যত্ন নেওয়ার প্রথম শর্ত হলো, জীবনের একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করা। আমাদের বেশির ভাগেরই জন্ম মধ্যবিত্ত পরিবারে। জাগতিক কিছু চাওয়া-পাওয়া পূরণ হওয়াই আমাদের কাছে সাফল্যের একমাত্র সংজ্ঞা। টানাটানির সংসারে বেড়ে ওঠার দিনগুলোতে যখন সাধারণ চাহিদাগুলো মেটাতে হিমশিম খেতে হয়, তখন মনে হতে পারে আর্থিক সচ্ছলতাই জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য। কিন্তু আসলে জীবন তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। তাই যদি হতো, তবে মুকেশ আম্বানি এত দিনে অফিস করা ছেড়ে দিতেন, শাহরুখ খান অভিনয় না করে বাসায় বসে থাকতেন, স্টিভ জবস নতুন মডেলের আইফোন বের করার জন্য চেষ্টা করতেন না, পিক্সার বিক্রি করে দিয়ে তিনি তো বিলিয়ন ডলার আয় করেই ফেলেছিলেন, আর কি চাই! চূড়ান্ত আর্থিক সাফল্য পাওয়ার পরও তাঁরা কেন কাজ করতেই থাকেন? কারণ, তাঁরা তাঁদের কাজকে ভালোবাসেন। কাজ তাঁদের বেঁচে থাকাকে অর্থপূর্ণ করে তোলে। আজকের চেয়ে আগামীকাল আরও ভালো কিছু করতে হবে—এই ভাবনা তাঁদের প্রতিনিয়ত প্রেরণা জোগায়।

তবে শুধু পড়াশোনা কিংবা ক্যারিয়ারের মধ্যে জীবনের লক্ষ্যকে আটকে ফেললে চলবে না। এমনভাবে লক্ষ্য স্থির করো, যা তোমাকে একটি সফল জীবন উপহার দেবে। আসলে সফলতার চেয়েও এখানে ভারসাম্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এর অর্থ, তোমার স্বাস্থ্য, অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক, শান্তি—সবকিছুকে একটি স্থিতিশীল অবস্থায় ধরে রাখা। কাছের মানুষের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে সেদিন চাকরিতে পদোন্নতি পেলেও তুমি সুখী হতে পারবে না। যদি সারাক্ষণ পিঠের ব্যথায় কষ্ট পেতে থাকো, তবে দামি গাড়ি চালিয়ে তোমার ভালো লাগবে না। দুশ্চিন্তায় অস্থির মন নিয়ে শপিং করার মধ্যে কোনো আনন্দ পাবে না তুমি। স্কুলে থাকতে যেমন চামচ মুখে নিয়ে মার্বেল দৌড়ে অংশ নিতে, জীবন তেমন একটা দৌড়। যদি চামচ থেকে মার্বেলই পড়ে যায়, তবে সবার আগে দৌড় শেষ করে কোনো লাভ নেই। সুস্বাস্থ্য আর প্রিয়জনের সঙ্গে সুসম্পর্ক ঠিক মার্বেলের মতো। সাফল্য তখনই অর্থপূর্ণ হয়ে উঠবে, যদি এসব বজায় থাকে। নয়তো লোকের চোখে সফল হবে ঠিকই, কিন্তু তোমার অন্তরের সেই আগুনের শিখা ধীরে ধীরে নিভে যাবে।

কাছের মানুষের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে সেদিন চাকরিতে পদোন্নতি পেলেও তুমি সুখী হতে পারবে না। যদি সারাক্ষণ পিঠের ব্যথায় কষ্ট পেতে থাকো, তবে দামি গাড়ি চালিয়ে তোমার ভালো লাগবে না। দুশ্চিন্তায় অস্থির মন নিয়ে শপিং করার মধ্যে কোনো আনন্দ পাবে না তুমি। স্কুলে থাকতে যেমন চামচ মুখে নিয়ে মার্বেল দৌড়ে অংশ নিতে, জীবন তেমন একটা দৌড়। যদি চামচ থেকে মার্বেলই পড়ে যায়, তবে সবার আগে দৌড় শেষ করে কোনো লাভ নেই। সুস্বাস্থ্য আর প্রিয়জনের সঙ্গে সুসম্পর্ক ঠিক মার্বেলের মতো।

আমার লেখার ব্যাপারে প্রতিদিন হাজার হাজার মন্তব্য আসে। অনেকে প্রশংসায় ভাসিয়ে দেয়, অনেকে যা-তা ভাষায় সমালোচনা করে। যদি সবার কথাই গুরুত্বের সঙ্গে নিতে চেষ্টা করি, তাহলে লিখব কীভাবে? আমাদের জীবন একটা নির্দিষ্ট মেয়াদের প্রিপেইড কার্ডের মতো। ভাগ্য খুব ভালো হলে হয়তো আমাদের হাতে আর ৫০ বছর সময় আছে, এই ৫০ বছরে বড়জোর আমরা দুই হাজার ৫০০ সপ্তাহ শেষের ছুটির দিন পাব। তাই একটু দম নিতে চেষ্টা করো—কিছু ক্লাস না-হয় ফাঁকি দিলে, কয়েকটা ইন্টারভিউ না-হয় হাতছাড়াই হলো, না-হয় কারও প্রেমেই ডুবলে! যত যা-ই হোক, আমরা মানুষ; যন্ত্র নই। তবে এসব কিছু করার পরও জীবনে ঝড় আসতে পারে। তখন দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ শর্তটি মনে রাখতে হবে, জানতে হবে কীভাবে ঝড়ের মুখেও আগুনের শিখাকে আগলে রাখতে হয়। যখন পরিকল্পনামতো কাজ এগোয় না, অথবা কাজ করলেও আশা অনুযায়ী ফল পাওয়া যায় না, তখন আমরা ভেঙে পড়ি। ব্যর্থতার ধাক্কা সামলে ওঠা কঠিন সত্যি, কিন্তু যে সামাল দিতে পারে, ব্যর্থতা তার শক্তি বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। নিজেকে প্রশ্ন কর এই ব্যর্থতা থেকে আমি কী শিখতে পারি? আমার প্রথম বই নয়জন প্রকাশক ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, আমি জানি, ব্যর্থতার আঘাত কত তীব্র হতে পারে। কিন্তু মনে রেখো, সেটি শুধুই আঘাত, ব্যর্থতা এর চেয়ে বেশি কিছুই করতে পারবে না, যদি তুমি ভেঙে না পড়ো। এটাই জীবন।

ব্যর্থতার হাত ধরে আসে হতাশা। কোনো কিছু কখনো আটকে গেলেই আমরা হতাশ হয়ে পড়ি। নিত্যদিনের ট্রাফিক জ্যাম থেকে শুরু করে পছন্দের চাকরি না পাওয়া—কখনো কখনো সময় যেন থেমে যায়, আমরা নিজেদের ওপর ভরসা হারিয়ে ফেলি। বই লেখার পর আমি ঠিক করি বলিউডের জন্য স্ক্রিপ্ট লিখব। লোকে বলে, আমি নাকি অসম্ভব ভাগ্যবান, আমার মাত্র (!) পাঁচ বছর সময় লেগেছে এই স্বপ্ন পূরণ করতে। আমি কীভাবে তখনকার হতাশাকে সামাল দিতাম? আমাকে বাস্তবতা বুঝতে হয়েছে, আমি কাজের ফল থেকে মনোযোগ সরিয়ে কাজ করে যাওয়াকে উপভোগ করতে শিখেছি। এমনকি আপাতদৃষ্টিতে খুব সাধারণ মনে হওয়া ব্যপারগুলো, যেমন প্রিয় বন্ধু, প্রিয় খাবার, ঘুরে বেড়ানো—এসবের মধ্যে আনন্দ খুঁজে নিয়েছি। মনে রেখো, জীবনের কোনো কিছুকেই অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ো না।

6439সবশেষে বলতে হয় একাকিত্বের কথা। যত বড় হবে, তত তুমি বুঝতে পারবে তুমি অন্যদের চেয়ে ভিন্ন। ছোটবেলায় সব শিশুই আইসক্রিম খেতে আর স্পাইডারম্যান দেখতে চায়, তুমিও এর ব্যতিক্রম ছিলে না। যখন বড় হয়ে কলেজে পা দিয়েছ, তখনো তুমি অনেকটাই তোমার বন্ধুদের মতো। কিন্তু ১০ বছর তুমি সবদিকেই আলাদা হয়ে উঠবে। তোমার স্বপ্ন, বিশ্বাস, অনুভূতি—এসব কিছু হয়তো তোমার সবচেয়ে কাছের মানুষটার চেয়েও অনেক, অনেক অন্য রকম হয়ে উঠবে। এই ভিন্নতা প্রায়ই অন্যদের সঙ্গে মতবিরোধ সৃষ্টি করে। হয়তো দেখা যাবে, সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে তোমাকে নিজের সঙ্গেই আপস করতে হচ্ছে, সবচেয়ে পছন্দের জিনিসগুলো ভুলে যেতে হচ্ছে। কলেজের বাস্কেটবল দলের অধিনায়ক জীবনের একটা সময়ে এসে খেলাই ছেড়ে দেয়। সংসার কিংবা সন্তানের ভবিষ্যতের চিন্তায় তারা ভুলে যায় একসময় এই খেলাকে তারা প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসত। আমি বলব, ভুলেও কখনো এমন আপস কোরো না, যা তোমার নিজের সত্তাকেই বদলে দেবে। নিজের ভেতর জ্বলতে থাকা আগুনের শিখাকে নিজের হাতে নিভিয়ে দিয়ো না, সেটিকে ভালোবাসতে শেখো।

উৎস : চেতন ভগতের নিজস্ব ওয়েবসাইট।

Sharing is caring!

Leave a Comment