নিঃশ্বাস নেওয়া মানেই বেঁচে থাকা নয়

নিঃশ্বাস নেওয়া মানেই বেঁচে থাকা নয়

  • লিডারশিপ ডেস্ক

জর্ডানের ২৩ বছর বয়সী পরিবেশবাদী আবদেল আলজোরগান। নিজের জন্ম শহর আত-তাফিলার তরুণ-তরুণীদের কাছে প্রকৃতি ও পরিবেশ এবং নিজের দায়বোধ সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে অনবদ্য ভূমিকা রেখে সারা পৃথিবীর কাছে একজন আদর্শ তরুণ হয়ে উঠেছেন তিনি।


আমার কাছে জীবন মানে হলো ‘বেঁচে থাকা’। মানুষ একসঙ্গে বেঁচে থাকবে, একই স্থান ভাগাভাগি করবে_ এমনটাই তো হওয়ার কথা। কিন্তু আপনি কি কখনও জীবন্মৃত মানুষের কথা শুনেছেন? যদি আমাকে প্রশ্ন করেন, ‘তুমি কি নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা কর?’ আমি হয়ত বলব, হ্যাঁ; কিন্তু নিঃশ্বাস নেওয়া মানেই বেঁচে থাকা নয়_ যতক্ষণ না আপনি ভিন্ন কিছু করছেন। কিন্তু কিশোর-কিশোরীদের অনুপ্রাণিত করার মতো উদ্যোগের বড় অভাব। অনেক উদাহরণ আছে অনুসরণ করার মতো; কিন্তু সমস্যা হলো, কেমন করে অনুসরণ করবে আর কেন করবে_ সে ব্যাপারটি স্পষ্ট থাকে না। ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে খামারে কাজ করতাম। তখনই আমি ধৈর্য ধরতে এবং ভবিষ্যত পরিকল্পনা করতে শিখেছি। কিন্তু একইসঙ্গে আমি ভাবতাম, আজকে আমরা যে ফসল বুনেছি, সেটিতে কীভাবে সেচ দেওয়া যায়। বাল্যকালে এই ভাবনা সব সময় কাজ করত মাথায়। ভাবতাম, পানি চক্র কীভাবে কাজ করে? আমরা কি পানি বাঁচাতে পারি? এটাকে কি আরও ভালোভাবে ব্যবহার করা যায়? তখন আমরা কেমন করে টাকা বাঁচাতাম? আমরা পানি কিনতে পারতাম না। আর বছরের ওই সময়টাতে উৎপাদন ততটা ভালো ছিল না যে, সেটা দিয়ে যথাযথভাবে পরিবার চালানো সম্ভব। আমি তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। এক রাতে হঠাৎ ভেবে পেলাম_ কী করে বাঁচানো সম্ভব! পদ্ধতিটা আমার কাছে খুব সোজা মনে হলো। তাছাড়া, যতটুকু আমার দরকার, ঠিক ততটুকুই ভাবনা ছিল আমার। কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকা ও জ্ঞান না থাকায় বুদ্ধিটাকে তখন কাজে লাগাতে পারিনি।

আমার ভাই মোহাম্মদের বয়স তখন ২১ বছর। আমি বিশ্বাস করেছি, কোনো কিছু যদি আমরা মনে প্রাণে চাই, তাহলে সেটা অবশ্যই অর্জন করতে পারব। আমরা জর্ডানের স্থানীয় সায়েন্স ফেয়ারে কৃতকার্য হলাম। তারপর সুযোগ পেলাম ইনটেল ইন্টারন্যাশনাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ফেয়ার ২০০৬ ও ২০০৮-এ অংশগ্রহণ করার। আর জীবনের প্রথমবার আমরা আমেরিকাতে গেলাম। এটা ছিল একটা স্বপ্ন সত্যি হওয়া যেন। টিভিতে দেখা অনেক কিছুর 11140137_10153219560593844_4773615651440815368_nবাস্তব পরিণতি দেখে আমরা দুই ভাই যারপরনাই শিহরিত হয়ে উঠি। ২০০৮ সালের প্রতিযোগিতায় আমরা চতুর্থ স্থান অর্জন করি। প্রথম কয়েক ঘন্টা ব্যাপারটা বিশ্বাসই হচ্ছিল না আমার! মনে আছে, পথটা অনেক লম্বা ছিল_ আমাদের ফান্ডিংয়ের ব্যবস্থা করতে হয়েছে, টিভি দেখে ইংরেজি শিখতে হয়েছে, প্রয়োজনের তুলনায় কম ঘুমাতে হয়েছে; কিন্তু আমরা যেটার স্বপ্ন দেখেছি, শেষ পর্যন্ত সেটা অর্জন করে ছেড়েছি। জর্ডানে ফিরে আসার পর নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য বিভিন্ন পথ অবলম্বন করলাম আমরা।

আমি আমাদের সমাজের কিশোর-কিশোরীদের সচেতন করতে চাইলাম। সমাজকে সাহায্য করার পর যে শক্তি আমি অনুভব করলাম নিজের মাঝে_ সেটিকে ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। আত্মবিশ্বাস আমাকে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে গেল। আমি আর কয়টা মানুষের মতোই_ পৃথিবীটাকে বসবাসের জন্য আরও ভালো করতে চাই। তবে এক্ষেত্রে শুরু করলাম নিজেকে দিয়ে। আমি সবসময় বিশ্বাস করি, ‘চিন্তা কর বৈশ্বিক, শুরু কর স্থানীয়ভাবে, আর কাজ কর এখনই’। এখন আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। সারাদিন পার হয়ে যায় পরীক্ষা আর হোমওয়ার্ক নিয়ে। তাই বলে থমকে দাঁড়াইনি। ভার্সিটির প্রথম কয়েক সপ্তাহে আমি কাজ শুরু করি স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে। নিজেকে উন্নত করি আর নিজের জানাশোনাকে অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করি। টিম মেম্বার হিসেবে আমি সবসময় আগে টিমের স্বার্থ দেখতাম; পরে আমার। আমি ‘লিডারস অব টুমরো’র সঙ্গে কাজ করেছি, জর্ডানের সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছি, ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে রিসার্চার হিসেবে কাজ করেছি, আরও যোগাযোগ বাড়িয়েছি এবং তারপরে আন্তর্জাতিক সুযোগ খুঁজেছি আমার ভাবনাকে আরও বিস্তৃত করার জন্য। কিছু সময় পর পর আমার সার্ভিসের স্টাইল পরিবর্তন করা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ; কেননা, এটা আমার জ্ঞানকে বিস্তৃত করে এবং বিভিন্ন সমস্যার সমাধান খুঁজতে সহায়তা করে।আমি জুরিখে ‘ওয়ান ইয়ং ওয়ার্ল্ড ফ্যামিলি’তে যোগ দিয়েছিলাম। অ্যাম্বাসাডরদের কিছু প্রজেক্ট দেখার একটা সুযোগ হয়েছিল তখন। আর তা দেখে সিদ্ধান্ত নিলাম, বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ে একটা প্রচারণামূলক কাজ আমাদের দেশেও করা উচিত। ফলে, বন্ধু খালিদকে নিয়ে একটি টিম গঠন করলাম। আর তাদেরকে বিশ্বাস করালাম_ যা আমি বিশ্বাস করি।

আমি যা করেছি, সব করেছি এমন একটা সমাজের তাগিদ থেকে_ যেখানে সবার জীবন ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আর সুখে ভরা থাকবে। কেউ আমাকে স্বপ্নবিলাসী বলতেই পারে; কিন্তু একটা মানুষ স্বপ্ন ছাড়া, আকাঙ্ক্ষা ছাড়া শুধুই নিঃশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকবে, তা হয় না। জীবন হলো অক্সিজেন গ্রহণ ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড ছাড়ার চেয়েও বেশি কিছু। ‘আমার ব্রেন আছে। সেটাকে কেউ আমার কাছ থেকে নিতে পারবেন না’ _ নিজেকে এমনটাই বলি আমি। কখনও কখনও জীবন আমাদেরকে বাধার মুখোমুখি করে, হতাশ করে; কিন্তু ভেঙে পড়া লজ্জার নয়_ যদি আপনি আবার এগোতে শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত, মানুষ হচ্ছে শরীর এবং আত্মার মিশ্রণ। আমরা শুধু একটির দিকে ধ্যান দিয়ে অন্যটিকে অবহেলা করতে পারি না। আমাদের কেউই এমন কোনো গাড়ি ব্যবহার করে না_ যেটার শুধু একপাশে দুটো চাকা। মানুষের সেবা করা এবং একে অপরকে সাহায্য করা, সত্যের সন্ধান করা আর দেখা স্বপ্নকে অর্জন করা, একটি সবুজ পৃথিবীর স্বপ্নে বাঁচা_ এই তো জীবন। এ পৃথিবী যেন আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য হয়, সে দায়িত্ব তো আমাদেরকেই পালন করে যেতে হবে।

সূত্র: সমকালfavicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment