বীমা বিধি পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি : ফারজানা চৌধুরী

বীমা বিধি পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি : ফারজানা চৌধুরী

  • লিডারশিপ ডেস্ক

২০১৩ সালে সাধারণ বীমা খাতের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেন ফারজানা চৌধুরী। তার হাত ধরেই দেশের বীমা খাতে নারী নেতৃত্বের সূচনা। এজন্য শিক্ষাজীবন ও কর্মক্ষেত্রে কৃতিত্বের সঙ্গে নিজেকে প্রস্তুত করেছেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্সের এ ছাত্রী প্রথম শ্রেণীতে তৃতীয় স্থান অধিকার করে এম.কম এবং পরবর্তীতে বৃত্তি নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার মোনাস ইউনিভার্সিটি থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। মালয়েশিয়া ইন্স্যুরেন্স ইনস্টিটিউট (এমআইআই) থেকে নেন ডিপ্লোমা সনদ। এর বাইরেও পেশাগত অনেক প্রশিক্ষণ রয়েছে তার। নিজের কর্মজীবন ও দেশের বীমা খাত নিয়ে সম্প্রতি বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেন তিনি। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন অনুপ সর্বজ্ঞ

প্রথমে আপনার কর্মজীবন সম্পর্কে জানাবেন।

কর্মজীবনের শুরুর দিকে ব্র্যাক ব্যাংকে এসএমই বিভাগের প্রধান হিসেবে সাত বছর কাজ করেছি। এছাড়া দেশের শীর্ষ এনজিও ব্র্যাকের গ্রামীণ উন্নয়ন প্রকল্পে আঞ্চলিক কর্মকর্তা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছি। ২০০৯ সালে গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) হিসেবে কাজ শুরু করি। এর আগে কোম্পানির পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছি।

দেশের বীমা খাতের একাধিক নতুন প্রডাক্ট এসেছে আপনার হাত ধরে। বীমা উন্নয়নে প্রডাক্টগুলো কতটা ভূমিকা রাখছে?

আমরা দেশের প্রত্যেক মানুষকে বীমার আওতায় আনতে চাই। এজন্য গ্রীন ডেল্টা প্রতিনিয়তই নতুন নতুন প্রডাক্ট নিয়ে কাজ করছে। তৃণমূল, ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্প, ছাত্র-ছাত্রী, নারী, কৃষি বীমা, প্রবাসী ও গার্মেন্টসকর্মীসহ সবার জন্য আমরা বীমা সুবিধা আনার কাজ করছি। পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় মেয়েদের জন্য কোনো বিশেষ বীমা পণ্য ছিল না। আমরা প্রথম ‘নিবেদিতা’ নামের একটি প্রডাক্ট চালু করেছি। ব্র্যাক ব্যাংকে থাকাকালে অনেকটা নিজ উদ্যোগে আমি ‘প্রথমা’ নামে একটি প্রডাক্ট চালু করেছিলাম।

প্রবাসীদের প্রশিক্ষণ, দুর্ঘটনা, পাসপোর্ট হারিয়ে যাওয়া, ভ্রমণে বিলম্ব এমন নানা বিষয় নিয়েও কাজ করছি। আমরা ডিজিটাল বীমা নিয়েও কাজ করছি। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রাহককে কীভাবে আরো স্বাচ্ছন্দ্য দেয়া যায়, সে চেষ্টা করছি। অনলাইন, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে কীভাবে প্রিমিয়াম জমা দেয়া যায়, নতুন পলিসি খোলা যায়, সেগুলো নিশ্চিত করছি আমরা। ছাত্রছাত্রীদের জন্য ৭৪ টাকায় ১ লাখ টাকা মূল্যের বীমা নিরাপত্তা দিচ্ছি আমরা। করপোরেটদের জন্য আমরা জিডি হেলথ নামে একটি পণ্য নিয়ে এসেছি। ১ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকার পলিসি। এর উপরে গেলে দেশের প্রায় ১১টি হাসপাতালে ক্যাশলেস সার্ভিসের সুযোগ আছে। আমাদের গ্রাহকদের সাধ্যের মধ্যে ভালো মানের চিকিত্সা দিতে মালয়েশিয়া, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর ও ভারতের সেরা কিছু হাসপাতালের সঙ্গে আমরা চুক্তি করেছি।

ভারতে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে বীমা পলিসি বিক্রি বেশ জনপ্রিয়। বাংলাদেশে এ পদ্ধতিতে কাজ করা যায় কিনা?

ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে বীমা পলিসি বিক্রির পদ্ধতিকে ব্যাংকাস্যুরেন্স বলা হয়। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোয় অনেক আগে থেকেই এটা চলে আসছে। আমাদের দেশে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) আপত্তি না থাকলেও অনুমোদন দিচ্ছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। তারা মনে করছে এর মাধ্যমে গ্রাহকের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে। তবে বিধি তৈরির মাধ্যমে যদি প্রক্রিয়াটি চালু করা যায় তাহলে ব্যাংক, বীমা কোম্পানি ও গ্রাহক প্রত্যেকেই লাভবান হবে বলে আমি মনে করি। দেশের সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাংকের যে গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, নানা কারণে বীমা এখন পর্যন্ত তা অর্জন করতে পারেনি। তাই ব্যাংককে এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা গেলে বীমার প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে। আর ব্যাংক এখানে কাজ করবে করপোরেট এজেন্ট হিসেবে। তাই ব্যাংকাস্যুরেন্স চালু হলে বীমা খাতে বিদ্যমান কমিশন বাণিজ্যও নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে আমি মনে করি।

বীমা ব্যবসার বাইরে গ্রীন ডেল্টা আর কী করছে?

বীমা ব্যবসার বাইরে গ্রীন ডেল্টা সিকিউরিটিজ ও গ্রীন ডেল্টা ক্যাপিটাল নামে দুটি সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান আছে আমাদের। গ্রীন ডেল্টা ক্যাপিটাল দেশের বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য অর্থ জোগানোর কাজ করছে। সামিট, বিএসআরএম ও প্রাণের মতো বড় শিল্প গ্রুপের জন্য আমরা তহবিল সংগ্রহ করে দিয়েছি। গ্রীন ডেল্টা সিকিউরিটিজ নানা উদ্ভাবনী প্রডাক্ট আর উন্নত সেবার মাধ্যমে পুঁজিবাজারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

বীমা খাতে দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে আপনাদের ভূমিকা—

আমি প্রধান নির্বাহী (সিইও) হওয়ার পর আরো দুটি কোম্পানি করেছি। এর একটি হলো জিডি অ্যাসিস্টস, অন্যটি পিএবিআই ইনস্টিটিউট। পিএবিআইয়ের মাধ্যমে বীমা শিল্পের জন্য দক্ষ জনশক্তি তৈরির কাজ করছি। এর জন্য এরই মধ্যে ট্রিপল আই, এনআই ইনস্টিটিউট ইন্ডিয়া, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও চার্টার্ড ইনস্টিটিউট অব লন্ডনের সঙ্গে চুক্তি করেছি। চার্টার্ড ইনস্টিটিউট অব লন্ডন প্রথম প্রাইভেট কোম্পানি হিসেবে গ্রীন ডেল্টার সঙ্গে চুক্তি করেছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রি নিতে অনেক টাকার প্রয়োজন। সবার পক্ষে এটি সম্ভব না। চুক্তি অনুযায়ী ছাত্রছাত্রী যত বেশি দেব, খরচ তত কমিয়ে দেবে তারা।

সরকারের সঙ্গে স্বাস্থ্য বীমা প্রকল্পে কাজ করছেন আপনারা। এর অগ্রগতি সম্পর্কে কিছু বলেন।

স্বাস্থ্য সুরক্ষা প্রকল্পে আমরা সরকারের সঙ্গে কাজ করছি। বর্তমানে টাঙ্গাইলের তিনটি উপজেলায় এ প্রকল্পের কাজ চলছে। এ প্রকল্পের আওতায় গ্রামের দরিদ্র মানুষকে বীমা সেবা দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে সরকার এসব বীমা পলিসির প্রিমিয়াম দিচ্ছে। এ পাইলট প্রকল্পের সাফল্যের ওপর ভিত্তি করে পর্যায়ক্রমে এর আওতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেবে সরকার। এর মাধ্যমে একদিকে বীমা শিল্পের পরিধি বাড়বে, অন্যদিকে গ্রামের দরিদ্র মানুষ আরেকটু বেশি নিরাপত্তা পাবে।

গ্রীন ডেল্টা নিয়ে আপনার ভবিষ্যত্ পরিকল্পনা কি?

বিদেশী কোম্পানির সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগে কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। বিশ্বের অনেক দেশে একটি বীমা কোম্পানি একই সঙ্গে লাইফ ও নন-লাইফ ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারে। আমাদের দেশে এখনো এটা শুরু হয়নি। তবে আমরা এ বিষয়ে আগ্রহী। নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে আইনি কাঠামোর মধ্যে থেকে আমরা এটা করতে চাই। তবে ঠিক কোন কোম্পানির সঙ্গে আমরা যৌথ বিনিয়োগে যাব, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। অনেকের সঙ্গেই আলোচনা চলছে। দেখা যাক কী হয়।

বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের কার্যক্রম সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন?

নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা, তাদের লোকবলের অভাব রয়েছে। এ কারণে তারা অনেক কাজই করতে পারছে না। সরকারের উচিত সংস্থাটিকে আরো শক্তিশালী হিসেবে গড়ে তোলা। পাঁচ বছরেরও বেশি সময়ে আইডিআরএ অনেক বিধি করেছে, আবার গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিধিই করতে পারেনি। তবে যেকোনো বিধি প্রণয়নের আগে তাদের উচিত সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করে নেয়া।

সার্বিকভাবে দেশের বীমা খাতের বর্তমান অবস্থা কেমন?

আমাদের দেশে বীমা কোম্পানির সংখ্যা অনেক বেড়েছে সত্য, তবে খাতটি এখনো অপরিণত। দেশের ১ শতাংশেরও কম মানুষ বীমার আওতায় এসেছে। জিডিপিতে বীমা খাতের অবদান ১ শতাংশেরও কম। তবে সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, মানুষ বীমার ব্যাপারে অনেক বেশি সচেতন হচ্ছে। বিভিন্ন বীমা পলিসির গুরুত্ব সম্পর্কে তারা জানতে শুরু করেছে।

নন-লাইফে একমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সাধারণ বীমা করপোরেশন (এসবিসি)। বীমা উন্নয়নে প্রতিষ্ঠানটির আরো বেশি ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে কি?

অবশ্যই আছে। বেসরকারি প্রতিটি সাধারণ বীমা কোম্পানি তাদের মোট ঝুঁকির ৫০ শতাংশ বাধ্যতামূলকভাবে এসবিসিতে পুনঃবীমা করছে। বাকিটা চাইলে বিদেশে করতে পারে। এসবিসিও তাদের ঝুঁকিগুলো বিদেশে পুনঃবীমা করে। এই পুনঃবীমার প্রিমিয়াম বাবদ প্রতি বছর কয়েক হাজার কোটি টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। কিন্তু এসবিসি যদি আরো শক্তিশালী হতো, তাহলে বেসরকারি খাতকে বিদেশে যেতে হতো না। দেশের টাকা দেশেই থাকত। আমি মনে করি, পুনর্গঠন ও অন্যান্য প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এসবিসিকে আরো শক্তিশালী করার সুযোগ আছে। তেমনটি হলে দেশী বীমা কোম্পানির পাশাপাশি বিদেশী বীমা কোম্পানিও এসবিসিতে পুনঃবীমা করতে আসবে।

আইডিআরএ শুরু থেকেই বলে আসছে, বীমা কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনা ব্যয় নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?

হ্যাঁ, এটা সত্যি যে ১৯৫৮ সালের বীমাবিধির ভিত্তিতে ব্যবস্থাপনা ব্যয় এখন অনেক বেশি। আমাদের কোম্পানির খরচও বেশি হচ্ছে। কিন্তু আমাদের এটাও বিবেচনা করা উচিত যে, এত বছর আগের নির্দেশনা এখন কতটা যুক্তিসঙ্গত। কারণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পারিপার্শ্বিক অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আমি মনে করি, এখন সময় এসেছে নতুন বিধি করার।

অতিরিক্ত ব্যয় সমন্বয়ে আইডিআরএর নির্দেশনার বিষয়ে আপনার অভিমত?

ব্যবসায়িক বাস্তবতার নিরিখে দেখলে আমি বলব, এটা কখনই সম্ভব না। ব্যবস্থাপনার জন্য একটি যৌক্তিক ব্যয় করতেই হবে।

এছাড়া আইডিআরএর পাশাপাশি তালিকাভুক্ত কোম্পানি হিসেবে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনও (বিএসইসি) আমাদের নিয়ন্ত্রক। আমরা করপোরেট গাইডলাইন অনুসরণ করি। আইন অনুযায়ী বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) শেয়ারহোল্ডার কর্তৃক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা ব্যয়সহ যাবতীয় এজেন্ডার অনুমোদন নেয়া হয়। তাই এ ব্যয় কোনোভাবেই অবৈধ না। সর্বোপরি ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের কারণে গ্রীন ডেল্টার গ্রাহক ও শেয়ারহোল্ডাররা কখনো কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হননি। এক্ষেত্রে আইডিআরএ কেন সব কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ব্যয় নিয়ে কঠোর হচ্ছে, তা আমার বোধগম্য নয়।

অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত বীমা। কিন্তু খাতটির বিদ্যমান বেতন-কাঠামা আকর্ষণীয় মনে করছেন না নতুন প্রজন্মের উচ্চশিক্ষিতরা। কর্মক্ষেত্র হিসেবে ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানকেই বেছে নিচ্ছেন তারা…

এখনো দেশের অধিকাংশ বীমা কোম্পানির সর্বনিম্ন বেতন ৮-১০ হাজার টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। অথচ ব্যাংকের ক্ষেত্রে তা প্রায় ২০ হাজার টাকা। এ অবস্থায় নতুন প্রজন্মের উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়েরা এ খাতে আসবেন কেন? বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোয় সুনির্দিষ্ট চাকরি বিধিমালা ও সুনির্দিষ্ট কর্মপরিধির অভাবও দক্ষতা বৃদ্ধির পথে একটি অন্তরায়। এসব কারণে বীমা ব্যবসা সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হচ্ছে না। পরিণতিতে গ্রাহক সন্তুষ্টিও বাড়ছে না। একদিকে কোম্পানির প্রিমিয়াম আয়ে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, অন্যদিকে অর্থনৈতিক উন্নয়নে বীমার অবদানও আশানুরূপ বাড়ছে না। favicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment