কল্পনাই আমার জীবনের সঙ্গী

কল্পনাই আমার জীবনের সঙ্গী

  • লিডারশিপ ডেস্ক 

সেই মুহূর্তটা মনে পড়ে৷ তখন গল্পগুলো বলতে চেয়েছিলাম—এটাই জানতাম৷ মনে হয়, সারাক্ষণই নিজেকে আনন্দে রাখার জন্য গল্প তৈরি করতাম নানা রকমের উপাদান মিশিয়ে৷ শৈশবটা নিঃসঙ্গতার মধ্য দিয়ে পার করেছি৷ আমার বয়স যখন মাত্র ছয় বছর, ভাইবোনেরা তখন থেকেই বাড়ির বাইরে চলে যায়৷ মা–বাবা তখনো বয়সে তরুণ৷ আমার প্রতি মনোযোগী হলেও তাঁরা অনেক ব্যস্ত ছিলেন৷ তাঁদের সঙ্গেই আমি থাকতাম কানেটিকাটের একটি ছোট খামারবাড়িতে৷ পেছনেই ছিল অরণ্য৷ খেলা করে সেই জঙ্গলের পাশে বহু বিকেল কাটিয়েছি৷ তখন অনেক স্বপ্ন দেখতাম আর নানা ভূমিকায় নিজেকে কল্পনা করে সে রকম ভান করতাম৷ বাবার চাকরির সূত্রে যখন আমরা আফ্রিকায় গেলাম, আমার কল্পনার পাখা আরও বিস্তার লাভ করল৷ সেই অযৌক্তিক কল্পনাই আমার সারা জীবনের সঙ্গী হয়েছে৷

বোন আর দুলাভাই আমাকে একবার ম্যাসাচুসেটসের ক্যামব্রিজে গন উইথ দ্য উইন্ড ছবিটি দেখাতে নিয়ে গেলেন৷ তখন আমার বয়স আট বছর৷ সম্পূর্ণ আবিষ্ট হয়ে প্রায় চার ঘণ্টার ছবিটি দেখেছিলাম৷ আর সেই অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়ে বিকেলের উজ্জ্বল সূর্যালোকে গিয়ে জানতে পারলাম আমার করণীয় কী৷ গল্পগুলো বলতে চেয়েছিলাম৷ আর তৈরি করতে চেয়েছিলাম এমন কিছু চরিত্র ও পরিস্থিতি, যেগুলো অন্যদের মধ্যে ঠিক সেই অনুভূতি ছড়িয়ে দেয়, যা আমার হয়েছিল চলচ্চিত্রটি দেখার মুহূর্তে৷ এসব অনুভূতির মধ্যে রয়েছে আবেগের আলোড়ন, কখনো সুখ, কখনো ভয়, কখনো বিস্ময় আর কখনো রসাত্মক ভাবপ্রবণতা৷ এটা যে এক আজীবন যাত্রার প্রথম ধাপ, সেটা তখন আমি বলতে গেলে টেরই পাইনি৷ শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত সেই যাত্রা থামার নয়৷ হয়তো তা আরও পরেও চলতে থাকবে৷ কারণ, আমি যদি অমর গল্প লিখতে পারি, সেগুলোর সঙ্গে আমিও বেঁচে থাকব৷

একজন লেখকের চলার পথ কতটা কঠিন, তা জানতাম না৷ কিন্তু লিখতে শুরু করে আর সেগুলো ছাপানোর জন্য পাঠানোর পর শিগগিরই টের পেলাম বাস্তবতা কতটা রূঢ়৷ বুঝতে পারলাম, প্রত্যাখ্যান আর মানসিক যাতনায় একজন লেখকের জীবন কতটা পরিপূর্ণ৷ কিন্তু একই সঙ্গে একজন লেখকের জীবন কতটা মর্যাদার, তাও জানতে পারলাম আমার প্রথম গল্প প্রকাশিত হওয়ার পর অথবা একটা অনুচ্ছেদ লেখার মাধ্যমে পাওয়া অসাধারণ আনন্দের অনুভূতির মধ্য দিয়ে৷

কোনো সাময়িকী বা প্রকাশকের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যান পাওয়ার পর নিজের আত্মবিশ্বাস ভেঙে কতটা বিহ্বল হয়ে যেত হয়, আমার জানা ছিল না৷ আবার কীভাবে আমি সেই ভগ্ন হৃদয়কে স্থির করে আবার চেষ্টা শুরু করব, সেটাও জানতাম না৷ তবু সেই চেষ্টা বরাবরই করেছি আমি৷ লেখক হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারটা আমাকে শিখিয়েছে একের পর এক প্রত্যাখ্যানের মুখেও ধৈর্য ধরে রাখতে হয়৷ আর সেই ধৈর্যের ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করে৷ লেখার ক্লাসের একজন শিক্ষকের কথা আমার মনে পড়ে৷ তিনি বলেছিলেন, ‘সফল লেখক আর অসফল লেখকদের মধ্যে পার্থক্য হলো, সফল লেখকেরা কখনোই হাল ছেড়ে দেন না৷’ কথাটা আমি আত্মস্থ করে নিয়েছিলাম৷

বোন আর দুলাভাই আমাকে একবার ম্যাসাচুসেটসের ক্যামব্রিজে গন উইথ দ্য উইন্ড ছবিটি দেখাতে নিয়ে গেলেন৷ তখন আমার বয়স আট বছর৷ সম্পূর্ণ আবিষ্ট হয়ে প্রায় চার ঘণ্টার ছবিটি দেখেছিলাম৷ আর সেই অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়ে বিকেলের উজ্জ্বল সূর্যালোকে গিয়ে জানতে পারলাম আমার করণীয় কী৷ গল্পগুলো বলতে​ চেয়েছিলাম

আমি লেখালেখি শুরু করি এমন একটা সময়ে, যখন দক্ষিণ এশীয় লেখকেরা যুক্তরাষ্ট্রে তেমন পরিচিতি পাননি৷ আর বাংলাদেশি লেখকের সংখ্যা তো ছিল সবচেয়ে কম৷ বেশির ভাগ প্রকাশক জানতেন না আমার লেখা কেমন হবে৷ তাঁরা আমাকে দেখতেন একজন বিদেশি হিসেবে, কিন্তু চাইতেন তাঁদের উপযোগী করে আমি যেন নিজের বিদেশিত্ব নিয়েই লিখি৷ অর্থাৎ তাঁরা গল্পগুলোর মধ্যে একধরনের বিদেশি স্বাদ পেতে চাইছিলেন৷ কিন্তু সে রকম আগ্রহ আমার ছিল না৷ আর আমি এটাও জানতাম, এভাবে লিখলে আমি আলাদা হয়ে যাব৷ চিরকালই পরিচিত হব একজন ‘দেশি লেখক’ হিসেবে, শুধুই লেখক হিসেবে নয়৷

জীবনে এমন কিছু মুহূর্ত এসেছিল, যখন আমি হাল ছেড়ে দিতে চেয়েছিলাম৷ আর তা করেও ছিলাম অল্প সময়ের জন্য, কিন্তু পুরোপুরি নয় কখনোই৷ আমি সব সময় সংক্ষেপে অনেক কিছু লিখে রাখতাম অথবা সেগুলো আমার মাথায় তালগোল পাকিয়ে ফেলত৷ ট্রেনে বা দোকানের সারিতে হয়তো কেউ কথা বলছিলেন, আমি পাশ থেকে সেটা শুনতাম৷ আর সেটাই আমার মধ্যে নতুন একটা ভাবনা জাগিয়ে তুলত অথবা একটা সংলাপের সূত্র ধরিয়ে দিত৷ আমি গল্পের পরিকল্পনা করতাম নিয়মিত৷ কিন্তু সেগুলোর বেশির ভাগই পরে বাতিল করে দিতাম৷ কারণ, এসব পরিকল্পনার বিস্তারিত মনে রাখতে পারতাম না৷ তবে সত্যিকার অর্থে আমি কখনো হাল ছাড়িনি৷ কিছুদিন লেখালেখি বন্ধ রাখতাম, শীতের সময় কিছু গাছ যেমন বিরতি নেয়৷ তারা যেন ঘুমিয়ে থাকে, আর বসন্ত না আসা পর্যন্ত প্রচণ্ড ঠান্ডা সহ্য করে৷ উষ্ণতর আবহাওয়ায় পরিবেশটা আগের চেয়ে বেসি বাসযোগ্য হলে এবং সূর্যের পরশ পেলে তারা আবার জেগে ওঠে৷ গল্পলেখক হিসেবে আমারও এ রকম চক্র ছিল৷ আশা আর আত্মবিশ্বাস আমি নতুন করে ফিরে পেতাম৷ কখনো শ্রদ্ধেয় কোনো মানুষের সদয় কথাবার্তা শুনে আশাবাদী হয়ে উঠতাম৷ আবার কখনো কেবলই লেখার প্রতি নিজের অনুরাগ আর তাড়না থেকে প্রেরণা ফিরে পেতাম৷ তাই বলতে হয়, লেখার আকাঙ্ক্ষাটা আসলেই অনেক বড়৷ সক্রিয়তার মাঝখানের শূন্য সময়গুলো নিজের বিকাশ আর পরিবর্তনের সুযোগও বটে৷ লেখকের জন্য বিশ্রাম যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি বেঁচে থাকার পার্থিব কিছু ব্যাপারও৷ লেখালেখি এমনই এক নিঃসঙ্গ প্রচেষ্টা, যাতে কখনো কখনো কাউকে এই পৃথিবীর বাইরে আরেক জগতে প্রবেশ করে তার সঙ্গে যুক্ত হতে হয়৷ এভাবেই একজন লেখক পূর্ণ ও সাবলীল হয়ে ওঠেন৷

এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আমি অটলভাবে এগিয়েছি৷ আমার গল্পগুলো প্রকাশ করেছি৷ আর এখন আমার একটা বইও বেরিয়েছে বিশ্বজুড়ে৷ একটি প্রকাশনা সংস্থা আমার ওপর আস্থা রাখে আর আমি আমার উপন্যাসের কাজটা প্রায় শেষ করে ফেলেছি৷ এমনকি আমি একটা নাটকও লিখেছি, যার প্রদর্শনী হয়েছে অনেকগুলো শহরে৷ ঢাকায়ও ২০১১ সালে নাটকটির প্রদর্শনী হয়৷ নিজের কাজই আমাকে অসাধারণ সুযোগ এনে দিয়েছে৷ আমেরিকার একটি টেলিভিশন সিরিয়াল ‘কোয়ান্টিকো’র লেখক দলে আমি জায়গা করে নিয়েছি৷ বলিউডের বড় তারকা প্রিয়াঙ্কা চোপড়া ওই সিরিয়ালে অভিনয় করছেন৷ আমি কখনোই এতটা আশা করিনি, আর এটাও জানি না এখান থেকে আমি ঠিক কতদূর পৌঁছাব৷ কিন্তু আমি কায়মনোবাক্যে আনন্দিত এ জন্য যে নিজের ওপর আস্থা কখনো হারাইনি৷

সূত্র: প্রথম আলো দলে দলে কাজ

Sharing is caring!

Leave a Comment