যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশি শাকিরের কৃতিত্ব

যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশি শাকিরের কৃতিত্ব

  • লিডারশিপ ডেস্ক

শাকিরের জন্ম বাংলাদেশের এক পাড়াগাঁয়ে। প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা বলতে হেফজখানায় থেকে আরবি শিক্ষা। ইংরেজি ভাষাজ্ঞান একদম নেই। ১৫ বছর বয়সী এমন কোনো ছেলের পক্ষে যুক্তরাজ্যে এসেই কি কলেজসেরা হওয়া সম্ভব? এমন অসম্ভবকেই সম্ভব করেছেন বাংলাদেশ থেকে আসা শাকির হোসেন। শুধু পরীক্ষায় সেরা ফল করা নয়; ইংরেজি ভাষা রপ্ত করে হয়ে উঠেছেন তারকা শিক্ষার্থী।

মোহাম্মদ শাকির হোসেন টাওয়ার হ্যামলেটস কলেজ থেকে সম্প্রতি এ লেভেল সমমান ‘ডিপ্লোমা ইন ইনফরমেশন টেকনোলজি’ বিষয়ে কলেজের সেরা ফল করেছেন। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন (ইউসিএল) থেকে তিনি ভর্তির প্রস্তাব পেয়ে এ বছরই ‘ইনফরমেশন টেকনোলজি ফর বিজনেস ম্যানেজমেন্ট’ বিষয়ে স্নাতক পর্ব শুরু করেছেন সেখানে।

টাওয়ার হ্যামলেটস কলেজে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অনেক শিক্ষার্থীই পড়ছেন। একই সময়ে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত রাইহানা খাতুন এই কলেজ থেকে ডিপ্লোমা ইন বিজনেস-এ ‘ট্রিপল ডিসটিঙ্কশন স্টার’ পেয়ে লেভেল থ্রি (এ লেভেল সমমান) উত্তীর্ণ হন। তিনি এখন কুইনমেরি ইউনিভার্সিটিতে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতক করছেন। আগামী সেপ্টেম্বরে যুক্তরাজ্যের খ্যাতনামা হিসাব নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান কেপিএমজিতে শিক্ষানবিশ হিসেবে তাঁর যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে। রাইহানার জন্ম লন্ডনে। আদিবাড়ি সিলেট শহরে। টাওয়ার হ্যামলেটস কলেজের প্রচারপত্রে রাইহানার ছবিও এবার স্থান পেয়েছে। আর শাকিরের কথা বিশেষভাবে প্রচার করছে কলেজটি।

বানিগ্রাম থেকে শ্যাডওয়েল
শাকির হোসেনের বাড়ি সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার বুধবারী বাজার ইউনিয়নের বানিগ্রামে। সাদিকুর রহমান ও সুফিয়া রহমান দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে সবার ছোট তিনি। বর্তমানে পূর্ব লন্ডনের শ্যাডওয়েল এলাকায় এই পরিবারের বসবাস। ২০ জানুয়ারি টাওয়ার হ্যামলেটস কলেজেই কথা হলো শাকিরের সঙ্গে। ছিলেন বাবা সাদিকুর রহমানও।

শাকির জানালেন, বাবা সাদিকুর রহমান বেশ আগে থেকেই যুক্তরাজ্যে থাকতেন। কিন্তু তাঁরা তিন ভাইবোন মায়ের সঙ্গে ছিলেন সিলেটে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর তাঁকে ভর্তি করে দেওয়া হয় একটি হেফজখানায়। সেখান থেকে সিলেট শহরের তাফিজুল কোরআন মাদ্রাসায়।

২০১২ সালের শেষের দিকে পরিবারের সঙ্গে লন্ডনে আসেন শাকির। শুরুতে ‘রেডব্রিজ হিল হাইস্কুলে’ ইয়ার ১১-এ (এসএসসি সমমান) ভর্তি হন। ইংরেজি জানতেন না। স্কুলে গিয়ে বেশ অসহায় অবস্থায় পড়েন। শাকির বলেন, ‘সেখানে কয়েক মাস কাটানোর পর ভোকেশনাল কোর্সে ভর্তির সিদ্ধান্ত নিই। ২০১৩-১৪ সেশনে টাওয়ার হ্যামলেটস কলেজে “ডিপ্লোমা ইন আইটি”–তে ভর্তি হই।’

টাওয়ার হ্যামলেটস কলেজের শিক্ষকেরা ভর্তির যাচাইমূলক পরীক্ষা শেষে হতাশ হয়ে আইটি বিষয়ে ‘লেভেল ওয়ান’ থেকে শুরু করতে বলেন শাকিরকে। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ না যেতেই নিজের চেষ্টা আর একাগ্রতায় শিক্ষকদের নজর কাড়তে শুরু করেন তিনি। তখন তাকে ‘লেভেল টু’তে উত্তীর্ণ করে দেওয়া হয়। এই শ্রেণিতে এক বছরের কোর্সে ৯টি ইউনিটের প্রতিটিতে ‘ডবল ডিসটিঙ্কশন স্টার’ (সর্বোচ্চ গ্রেড) অর্জন করেন শাকির। আর দুই বছরমেয়াদি ‘লেভেল থ্রি’র ১৮টি ইউনিটের পরীক্ষায় গড়ে ‘ট্রিপল ডিসটিঙ্কশন স্টার’ (সর্বোচ্চ গ্রেড) পেয়ে তাক লাগিয়ে দেন সবাইকে।

শাকির বলেন, ইচ্ছা আর একাগ্রতা থাকলে অনেক কিছু্ অর্জন সম্ভব। অবশ্য নিজের এই অর্জনের জন্য বাবা-মায়ের সচেতনতা আর কলেজশিক্ষকদের বাড়তি যত্নকেও কৃতিত্ব দেন তিনি। মাত্র তিন বছরে সবকিছু আমূল বদলে গেল—মন্তব্য করেন শাকির। বললেন, যুক্তরাজ্যে বেড়ে ওঠা তাঁর বয়সী অনেক শিক্ষার্থী পড়ালেখাকে পাত্তা না দেওয়ায় ছিটকে পড়েছেন। যত দূর সম্ভব পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চান। আর একজন ভালো মানুষ হওয়াটাই জীবনের লক্ষ্য। অন্যের জীবনকে বদলে দেওয়ার জন্য কিছু করতে পারলে সেটাই হবে সার্থকতা।

শাকিরের বাবা সাদিকুর রহমান পূর্ব লন্ডনের একটি মসজিদের ইমাম। তিনি বলেন, ‘ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি অবশ্যই প্রত্যেক বাবা-মায়ের উচিত প্রচলিত আধুনিক শিক্ষায় সন্তানদের শিক্ষিত করা। একজন সচেতন নাগরিক হওয়ার জন্য আধুনিক শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই।’ তিনি বেশ গর্ব করেই জানালেন, তাঁর বড় ছেলেও কুইনমেরি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন।

শাকির যদি বাংলাদেশে থাকতেন, তাহলে এখন কী করতেন? হাসি দিয়ে শাকিরের জবাব, ‘দেশে থাকলে হয়তো এখন যা হয়েছে তা হতো না।’ পরক্ষণেই বলেন, বাংলাদেশে মাদ্রাসাশিক্ষার আধুনিকায়ন জরুরি। এতে ধর্মীয় উগ্রবাদও হ্রাস পাবে। সুযোগ আর উপযুক্ত পরিবেশ পেলে বাংলাদেশের বঞ্চিত শিক্ষার্থীরাও আমূল বদলে যেতে পারবে বলে মন্তব্য তাঁর।

সূত্র: প্রথম আলোfavicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment