সাঁইজির আখড়ায় বাউল মেলা

সাঁইজির আখড়ায় বাউল মেলা

  • শাহজাহান নবীন, কুষ্টিয়া

‘মিলন হবে কতো দিনে,, আমার মনের মানুষেরও সনে…আমার মনের মানুষেরও সনে” বাউল সাধক লালন ফকিরের অমর কীর্তি এই গানের পঙক্তি আজ পূর্ণ হয়েছে। বিচ্ছেদের ভার দুরে ঠেলে মনের মানুষের সান্নিধ্যে হাজারো ভক্ত। মনের বাউল গত হয়েছে কত শতাব্দী পূর্বে, তবু ভক্তের আকুতির কাছে ভক্তি প্রণামের মধ্যদিয়ে স্বপ্রাণে ধরা দিয়েছেন ‘লালন’। প্রতি বছরের দোল পূর্ণিমায় হাজারো বাউল সাধকের প্রাণের মেলায় মেতে ওঠে কালিনদীর পাড়। বাউল গান, সাঁইজিকে আরাধনার মধ্যদিয়ে চলছে বাউল উৎসব।

কুষ্টিয়ার কুমারখালির ছেউড়িয়ায় লালনের আখড়া বাড়ীতে শুরু হয়েছে স্মনণোৎসব। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় অধিবাসের মধ্যদিয়ে ২৪ ঘন্টার দোলসঙ্গ শুরু হয়। দোলসঙ্গে বাউল সাধক ও লালনের ভক্ত-অনুরাগীরা চৈত্রের পূর্ণিমা রাতে জোছনার ছটায় মেতে উঠে উৎসবে। মৃদুমন্দ মাতাল হাওয়ার সুরের সাথে সাঁইজির গানে গানে সবাই হারিয়ে যায় ভীন জগতে।

বৃহস্পতিবার প্রথম প্রহরে গোষ্ঠগানের মধ্যদিয়ে বাউল সাধকরা সাধন ভোজন শুরু করে। তবে বাউল তত্বের রীতি অনুযায়ী, মঙ্গলবার রাতে দোলসঙ্গ শুরুর পর রাত থেকেই সাধুসঙ্গ শুরু হয়। এছাড়া বুধবার সকালে গোষ্ঠগানের পর বাউল সাধকরা তাদের আচার অনুষ্ঠান পালন করছে। আখড়ার মুল প্রাঙ্গনসহ আশেপাশের বিভিন্ন জায়গায় জমেছে বাউল সাধকদের ছোট ছোট মজমা। সেই সাথে ভক্তদের মুখে মুখে লালনের গান পুরো এলাকার পরিবেশে এনেছে নতুন মাত্রা।

‘জাত গেল জাত গেল বলে, একি আজব কারখানা…’ বাউল ফকির শাহেন শাহ’র কন্ঠে গাওয়া এ গান সকল দর্শনার্থীদের মাঝে ভাবাবেগের সঞ্চার করে। এরপরই বাউল প্রসন্ন শাহ তার গলায় তুললেন, ‘বলি মা তোর চরণ ধরে…ননী চুরি আর করবো না..আর আমারে মারিস নে মা’। প্রসন্নের গান শেষ হওয়ার আগেই আবেগে অনেকের গলা ভারী হয়ে যায়। এমনই অনবরত লালন গানের সুরের মায়ায় দিক ভুলে যেতে চাই অনেকে।

দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লালন সাধক বা বাউল সাধকেরা এসেছে সাঁইজির সান্নিধ্য পেতে গড়াই ও কালীনদীর ঘাটে। পশ্চিমবঙ্গ থেকেও এবছর হাজারো ভক্ত এসেছে গুরুর স্মরণে। বাউল সাধক ও লালন অনুরাগী প্রবাল, সৌমিত্র খের, মৃন্ময় সাহা বলেন-‘প্রতিবছর সাঁইজিকে দেখতে আসি। প্রাচীরের ওপারে থাকলেও মন পড়ে রয় গুরুর চরণে। সুযোগ পেলেই ছুটে আসি এখানে। গুরুর দর্শনে মন ফিরে পায় তেজ। তাই বার বার ফিরে আসা।’

বাউল সাধক হৃদয় শাহ বলেন-‘লালন শাহের মানব কল্যাণকর কথা ও গানগুরো ধারণ করে দীর্ঘদিন ধরে লালন আখড়ায় আসা যাওয়া বাউল সাধকদের। মানবধর্মই বড় ধর্ম। মানব প্রেম-ভালবাসায় পারে মানবধর্মকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে। এ তত্বেই বাউল যত ফিরে আসে এই দোল উৎসবে।’

এবছর দোল উৎসবে ভারত থেকে এসেছিলেন উপমহাদেশের অন্যতম বাউল পূর্ণদাস বাউল। তিনি বলেছিলেন, আখড়া বাড়িতে আসলে আমার মনে হয় ঈশ্বরের পাশেই আছি। এখানে এলে আমি প্রাণ ফিরে পাই। পূর্ণদাস বাউলের শিষ্য বাউল শিল্পী পাপিয়া ঘোষাল বলেন- ‘আখড়াবাড়িতে এসে যে আত্মিক প্রশান্তি পেয়েছি তা বলে বুঝাবার নয়। বারবার ফিরে আসতে চাই এই প্রাণের আখড়ায়।’

এদিকে আয়োজক কমিটি সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার রাত নয়টায় লালন একাডেমির মুলমঞ্চে  স্মরণোৎসবের উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ।

দোল পূর্ণিমার এই বাউল উৎসবের আমেজে যখন মেতে উঠেছে প্রতিটি বাউল প্রাণ তখনই লাগাম টেনেছে ওই পূর্ণিমার আলো। সাধুসঙ্গ, গোষ্ঠিগান আর সাঁইজির আরাধনার মধ্যদিয়ে চলা ভক্তকুলের মিলনমেলা আজ রাতে সাঙ্গ হবে।

বছর ঘুরে আবার আসবে চৈত্রের পূর্ণিমা। নীড়ে ফিরবে বাউলাদের ঝাঁক। ফের মেতে উঠবে ছেউড়িয়া ঠিক এই গানের সুরে…‘তিন পাগলের হলো মেলা নদে এসে..ওরে মন নদে এসে..তোরা কেউ যাস নে ও পাগলের কাছে’।favicon59

Sharing is caring!

Leave a Comment