সুবর্ণচরের ৯০ স্কুলে মিডডে মিল

সুবর্ণচরের ৯০ স্কুলে মিডডে মিল

  • নিউজ ডেস্ক

কার্তিক মাসের ভরদুপুর। চরবাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের টিফিন বিরতি। আশ্চর্য ব্যাপার যে একটা শিশুও স্কুলের মাঠে খেলছে না। স্কুলের বারান্দায় দেখা গেল ক্লাসরুমগুলোতে যেন ভুরিভোজ চলছে। বাচ্চারা শুধু নয়, স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারাও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে খাচ্ছেন।

ভাবলাম আজ স্কুলে হয়তো কোনো আয়োজন আছে তাই সবাই একসঙ্গে খাচ্ছে। ভাবনা ভুল ‘আমাদের স্কুলে নিয়মিত ছাত্র-শিক্ষক দুপুরের খাবার নিয়ে আসে, আর সবাই একসঙ্গে খাই। এটা আমাদের মিডডে মিল’—বললেন শিক্ষিকা আমেনা বেগম। এটা তাহলে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত মিডডে মিল?  আমেনা বেগম জানালেন ‘বলতে পারেন, তবে এটা একটু আলাদা, এতে আমাদের সরকারের বা কোনো প্রতিষ্ঠানের অর্থ খরচ হয় না।’

সুবর্ণচরে চরবাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের খ্যাতি অনেক আগে থেকেই। পাশে চরবাটা খাসের হাট উচ্চ বিদ্যালয় এবং এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সৈকত বিশ্ববিদ্যালয়। এই স্কুলে এই রকম ভিন্ন আয়োজন খুব একটা বলার মতো ঘটনা না। শিক্ষক-অভিভাবকদের আন্তরিকতায় পুরো উপজেলায় একটি স্কুলে এ রকম ঘটনা হতেই পারে। কিন্তু এসব কথা মানতে নারাজ প্রধান শিক্ষিকা হাজেরা খাতুন। তিনি বলেন, ‘২০১৫ সালের ৩০ এপ্রিল আমাদের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন হারুন অর রশিদ। কয়েক মাস যেতে না-যেতেই তিনি আমাদের স্কুলগুলোতে মিডডে মিল চালুর সিদ্ধান্ত নেন। শুরুতে ভেবেছিলাম অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে। পরে দেখি বিষয়টা খুব সহজ। শুধু তার আন্তরিকতায় এখন পুরো উপজেলায় সব স্কুলে মিডডে মিল চালু হয়ে গেছে। তিনি আমাদের সঙ্গে মিটিং করেছেন, মায়েদের সঙ্গে মিটিং করেছেন, অভিভাবক ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে মিটিং করেছেন। তারপর তিনি এবং উপজেলার বিভিন্ন কর্মকর্তাদের প্রচেষ্টায় এখন এটা খুব সহজ হয়ে গেছে। তিনি স্লোগান ঠিক করে দিলেন—দুপুরের খাবার স্কুলে খাব, রোগমুক্ত জীবন গড়ব। এখন সুবর্ণচরের যে স্কুলেই যান, শুনতে পাবেন এই স্লোগান। পুষ্টির কথা বাদ দিলেও মিডডে মিলের আরো দুটো সুফল আমরা হাতে হাতে পেয়েছি। আগে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার কম ছিল। স্কুলে এলেও দুপুরের পর ক্লাস কামাই করত অনেকে। এখন সেটা অনেক কমে গেছে। আরেকটা হলো, কেউ কোনো দিন খাবার কম আনলে অন্যরা তাকে দিচ্ছে, ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের সামাজিক বন্ধন তৈরি হয়েছে।’

শুরুটা যেভাবে

সুবর্ণচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হারুন অর রশিদ বলেন, ‘এক দুপুরবেলা অফিসে খুব একটা কাজ ছিল না। উপজেলা কমপ্লেক্সের পাশেই উত্তর চর জুবিলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ভাবলাম স্কুলটা একটু ঘুরে আসি। স্কুলে বাচ্চাদের সঙ্গে মিশতে চেষ্টা করি। নানা বিষয়ে মজার মজার কথা বলছি, প্রশ্ন করছি। কিন্তু ওদের মধ্যে কোনো চাঞ্চল্য নেই, মুখগুলো কেমন যেন মলিন, তাদের রেসপন্সও ভালো না। ওদের জিজ্ঞেস করলাম—তোমরা দুপুরে খেয়েছ? সমস্বরে ‘না’ বলার সময় বাচ্চাদের চোখও যেন ছলছল করে উঠল। আমিও সেদিন অনেকক্ষণ কিছু খাইনি। আমারও খিদে ছিল। ভাবলাম আমার মতো বড় মানুষ না খেয়ে কষ্ট পাচ্ছি আর বাচ্চারা সেই সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত না খেয়ে থাকে! এটা আগে কখনো বুঝতে পারিনি। আমরা যখন স্কুলে পড়তাম তখনো দুপুরে খাবারের কথা মনে থাকত না। এটা নিয়ম হয়ে গেছে। সেদিন আমার সঙ্গে সাংবাদিক আব্দুল বারী সাহেবসহ এলাকার একজন মেম্বার ছিলেন। তাদের পরামর্শ চাইলাম। চাইলেই হয়তো সরকারি তহবিল থেকে কিছু একটা করতে পারতাম। কিন্তু সেটা দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ হতো না। ফলে চেয়েছি কাজটা এমনভাবে করতে, যেন আমি চলে যাওয়ার পরও বাচ্চাদের মিল বন্ধ না হয়। এ নিয়ে কয়েক দিন পর আমরা উপজেলার মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক ও অভিভাবকদের সঙ্গে মতবিনিময় করি। সেখানে অভিভাবকদের প্রস্তাব দিই, বাচ্চাদের দুপুরের খাবার বাড়ি থেকে পাঠানোর জন্য। অধিকাংশই নানা অজুহাত দিতে থাকলেন। কেউ বললেন, স্যার, আমরা গরিব মানুষ। কেউ বললেন, দুপুরে আমরা কাজে যাই, ভাত দিমু কেমনে? বা দুপুরে হালকা কিছু খেলে তো হবে ইত্যাদি। আবার অনেকে উৎসাহও দিলেন। সেই থেকে এটা চালু হয়ে গেল। প্রথম প্রথম সবার বাড়ি থেকে খাবার দিত না। আমি সময় পেলেই একেকটা স্কুলে যেতাম। একটা সময় সবার আগ্রহ বেড়ে গেল। আব্দুল বারী এবং আমাদের কর্মকর্তারা অনেক পরিশ্রম করেছেন। উপজেলা চেয়ারম্যানও এটা দেখে ভারী খুশি হলেন। তিনিও স্কুলগুলো পরিদর্শন করতে থাকলেন। এভাবে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পুরো উপজেলায় ৯০টি স্কুলে মিডডে মিল চালু হয়ে গেল। এখন ১৭ হাজার ৪৪০ জন শিক্ষার্থী নিয়মিত স্কুলে খাবার খায়। বাচ্চারা খাবার আনতে ভুলে গেলে অভিভাবকরা খাবার নিয়ে আসেন। ক্লাসের শিক্ষক তার বাচ্চাদের নিয়ে একসঙ্গে খান। এখানে ছাত্রদের মধ্যে একটা ভালো বন্ধন তৈরি হয়ে গেছে। যার খাবার কম থাকে তাকে অন্যরা একটু একটু করে দিয়ে থাকে। দেখা যায় যে খাবার আনেনি বা কম এনেছে তার খাবারই বেশি হয়ে যায়। জেলা প্রশাসক স্যার শুনে খুশি হলেন। এখন তিনি নিজে এসব তদারকি করেন। তিনি নোয়াখালীর বাকি আটজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নিয়ে আসেন আমাদের কাজ দেখাতে।

খাবারের বিষয়টা শেষ করার পর খুব কম সময়ে আমরা আরেকটা কাজ করে ফেলি। সেটা হলো পুরো উপজেলায় সব শিক্ষার্থী এখন স্কুল ড্রেস পরে স্কুলে যায়।’

সরেজমিনে

চরবাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কথা হয় শিক্ষিকা শারমিন আক্তারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার বাসা এই যে মাঠের দক্ষিণ পাশে কিন্তু দুপুরের খাবারটা এখানেই খাই। বাচ্চাদের সঙ্গে একসঙ্গে খেতে ভালো লাগে। একসঙ্গে খেতে প্রথমে বাচ্চারা জ্বালাতন করত। এখন কোনো ঝামেলা নেই। সবাই মিলেমিশেই খায়।’

সুবর্ণচরের পুরো উপজেলায় এখন বাচ্চারা সময়মতো খাবার খায়। নিজের হাত নিজে ধুয়ে খেয়ে আবার নিজের বাটি ধুয়ে রাখে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে। স্কুল ড্রেসটি ঠিক রাখে। কথা হয় সুবর্ণচর উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ খায়রুল আনাম সেলিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘অধিকাংশ শিশুর রোগবালাই হয় অপুষ্টির কারণে। দুপুরে নিয়মিত খাবার খেলে অপুষ্টির আশঙ্কা থাকে না। আমাদের ইউএনও শতভাগ স্কুল ড্রেস, শতভাগ মিডডে মিল চালু করে পিছিয়ে পড়া এই জনপদকে অনেক এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। দেখবেন একদিন আমাদের বাচ্চাদের স্লোগান—দুপুরের খাবার স্কুলে খাব, রোগমুক্ত জীবন গড়ব, সারা দেশের শিশুদের মধ্যে ছড়িয়ে যাবে।’

সূত্র: কালের কণ্ঠfavicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment