বগুড়ার উদ্যোক্তাদের সৃষ্টিশীলতা

বগুড়ার উদ্যোক্তাদের সৃষ্টিশীলতা

  • অর্থ ও বাণিজ্য ডেস্ক

শিল্প জেলা বগুড়ায় পাট নতুন করে জেগে উঠেছে। ১৭ বছরে এ জেলায় ১৭টি পাটকল গড়ে উঠেছে। সব কটিই বেসরকারি খাতের, চালু এবং লাভজনক। আদমজী পাটকল ২০০২ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এর পরিত্যক্ত যন্ত্র দিয়েই বগুড়ায় পাটকলের নবযাত্রা শুরু।

আদমজীর যন্ত্রপাতির আদলে পাটকলগুলোর জন্য যন্ত্রপাতিও তৈরি হচ্ছে এখন বগুড়াতেই। এতে লাভ হচ্ছে চারদিক থেকে। কৃষকেরা পাট চাষে উৎসাহী হচ্ছেন, যন্ত্রপাতি আমদানিতে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে না, রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে এবং চাল, গম ও সারের বস্তা হিসেবে দেশীয় চাহিদা মিটছে।

বগুড়া সদরেই গড়ে উঠেছে ছয়টি পাটকল। এর মধ্যে আকাশতারা নামক এলাকায় বগুড়া পাটকল, ধরমপুরে এম এম পাটকল, হরিগাড়িতে হাসান পাটকল, মানিকচকে খন্দকার পাটকল, আজাদ পাটকল এবং আজাদবাংলা পাটকল। শহরের পাশে ঠেঙ্গামারায় গড়ে উঠেছে প্রগতি পাটকল।

কাহালু উপজেলার তিন পাটকলের মধ্যে রয়েছে বগুড়া ভান্ডার পাটকল, আফরিন পাটকল ও হাসান পাটকল। হাসান পাটকলের আবার রয়েছে জেলায় দুটি কারখানা। শিবগঞ্জ উপজেলায় দুটি পাটকল—মালাহার এলাকায় পাইকড় পাটকল ও জয় পাটকল।

এ ছাড়া শাজাহানপুর উপজেলায় মোহিনী নাবিল পাটকল, শেরপুর উপজেলায় করতোয়া পাটকল, নোনগোলা উপজেলায় এম কে পাটকল এবং গাবতলী উপজেলায় গড়ে উঠেছে শাহ সুলতান পাটকল।

কেউ কেউ আদমজী থেকে তাঁত যন্ত্রপাতি কিনে কারখানা শুরু করলেও অনেকে ভারত ও চীন থেকে তাঁত এনে কারখানা স্থাপন করেছেন। বগুড়া ভান্ডার পাটকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হাজি তোফাজ্জল বলেন, তিনি ভারতীয় যন্ত্রপাতিতে কারখানা স্থাপন করেন এবং পাটপণ্য রপ্তানিও করেন ভারতে। তাঁর কারখানায় ৮০০ শ্রমিক কাজ করেন বলে জানান তিনি।

গত ২৭ ডিসেম্বর শাহ সুলতান পাটকল সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, শ্রমিকেরা কাজ করছেন। কর্মচারীরা বলেন, ৫০০ শ্রমিক ৮ ঘণ্টা করে ৩ শিফটে কাজ করেন এ কারখানায় এবং এখানে মাসে ৩ হাজার মণ সুতলি ও ১ লাখ পিস বস্তা তৈরি হয়।

পাটকল মালিকেরা বলেন, বগুড়ার পাটকলগুলোতে ১০ হাজারের মতো লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। এর মধ্যে অর্ধেক কর্মচারীই নারী। বগুড়া পাটকলে গত ২৮ ডিসেম্বর সরেজমিনে দেখা যায়, কারখানায় সুতলি ও বস্তা উৎপাদন হচ্ছে। কয়েকজন শ্রমিক নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, তাঁদের মজুরি খুবই কম। ৮ ঘণ্টা কাজ করে তাঁরা পান দিনে ১২০ থেকে ১৫০ টাকা।

পাটকলগুলোর মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বগুড়ায় প্রত্যেকটিতে গড়ে ১০ টন সুতলি ও বস্তা তৈরি হচ্ছে। এসব কলে প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ মণ কাঁচা পাট লাগে।

আফরিন পাটকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) খলিলুর রহমান বলেন, আদমজী থেকে যন্ত্রপাতি কিনে তিনি পাটকল স্থাপন করেন বগুড়ায় এবং তাঁর কারখানায় দিনে ১৩ টন পণ্য উৎপাদন হচ্ছে।

মোহিনী নাবিল পাটকলের এমডি এম এ মুন্নাফ বলেন, তিনিও আদমজী থেকে চার কোটি টাকার তাঁত কিনে কারখানা চালু করেছিলেন। পরে আরও তাঁত বসান এবং সেগুলো আদমজী থেকে কিনে আনা যন্ত্রের আদলে বগুড়ার ফাউন্ড্রি কারখানা থেকেই তৈরি করিয়ে নেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, বগুড়ার পাটকলগুলো চাষিদের কাছ থেকে সরাসরি পাট কিনছে। এতে চাষিরা ভালো দাম পাচ্ছেন এবং পাট চাষে উৎসাহী হচ্ছেন তাঁরা। মাঝেমধ্যে ফড়িয়ারাও বাড়িতে এসে পাট কিনে নিচ্ছেন।

জানতে চাইলে বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাছুদুর রহমান বলেন, অন্য পাটকলগুলো যেখানে প্রতিবছর লোকসান গুনছে, সেখানে বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বগুড়ার পাটকলগুলো ভালো করছে। বিষয়টিকে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত এবং বগুড়ার উদ্যোক্তাদের সৃষ্টিশীলতা বলে মনে করেন তিনি।

তবে সমস্যার চিত্রও রয়েছে কলগুলোর। এগুলোতে সব সময় বিদ্যুৎ থাকে না। ফলে কাজ বন্ধ রাখতে হয়। গত দুই মাসে সমস্যা একটু কাটলেও আগের ছয় মাস অধিকাংশ সময়ই কারখানা বন্ধ রাখতে হয়েছে। মালিকেরা আরও বলেন, বিদ্যুৎ ও গ্যাস পাওয়া গেলে বগুড়ায় আরও পাটকল হওয়ার মতো বাস্তবতা আছে। কিন্তু গ্যাসের ব্যাপারে সরকারের কাছ থেকে কোনো সবুজ সংকেত নেই বলে নতুন পাটকল স্থাপনে তাঁরা মাথা ঘামাচ্ছেন না।

বগুড়ার পাটকলগুলোর উৎপাদিত বস্তা রপ্তানি হচ্ছে ভারত, জার্মানি, জাপান, মালয়েশিয়া, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও তুরস্কে। দেশগুলোর আমদানিকারকেরা আদেশ দেওয়ার পর তাদের দেওয়া শর্ত অনুযায়ী বস্তা তৈরি করা হয় বলে জানান মালিকেরা। রপ্তানিতে এগিয়ে অবশ্য পাইকড়, আফরিন ও হাসান—এই তিন পাটকল।

রপ্তানির বাইরে দেশীয় বাজারের বিষয়টিকেও গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন বগুড়া ভান্ডার পাটকলের এমডি হাজি তোফাজ্জল। তিনি বলেন, ‘পাটপণ্যের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার আইনটি আমাদের দম দিয়েছে। এখন বস্তা তৈরি করে ফেলে রাখলেও চিন্তা করতে হয় না। কারণ পাটের তৈরি বস্তাই এখন চলছে সার ও চালের ক্ষেত্রে।’

সূত্র: প্রথম আলোfavicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment