কেউ হতে চায় লিডার, কেউবা ম্যানেজার…

কেউ হতে চায় লিডার, কেউবা ম্যানেজার…

১৯৮৬ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২৭ বছর জনপ্রিয় ফুটবল ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ম্যানেজার ছিলেন স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন। তাঁর তত্ত্বাবধানে ১৩ বার ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ ও ২ বার উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা অর্জন করে ম্যানচেস্টার। স্যার অ্যালেক্সকে মনে করা হয় ব্রিটিশ ফুটবলের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল ম্যানেজার। তিনি ম্যানেজার থাকাকালীন সময়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড সবমিলিয়ে ৩৯টি ট্রফি জয় করে। ম্যানচেস্টার থেকে অবসর নেওয়ার পর হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের ‘এক্সিকিউটিভ এডুকেশন প্রোগ্রাম’-এ এক্সিকিউটিভ ফেলো হিসেবে যোগ দিয়েছেন ৭৩ বছর বয়সী এই কিংবদন্তী। সম্প্রতি এই সফল ক্লাব-ম্যানেজারের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সিয়ান সিলভারথোর্ন। সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশ অনুবাদ করেছেন মারুফ ইসলাম


AlexFergusonসিলভারথোর্ন : শিক্ষার্থীরা প্রায়ই জিজ্ঞেস করে থাকে, তাদের ম্যানেজার হওয়া উচিত নাকি লিডার হওয়া উচিত। আমরা জানি, আপনি একজন সফল ম্যানেজার। আপনার দৃষ্টিতে সফল ম্যানেজার হতে হলে কোন বিশেষ গুন থাকা জরুরি।

ফার্গুসন : কোনো একটা ম্যাচ জেতার পর আমি কখনোই পেছনে ফিরে তাকাতাম না। কারণ অতীত কখনো সুখের স্মৃতি মনে রাখে না বলেই আমার ধারনা। আমি তাই সামনের দিকে তাকানোয় বিশ্বাসী। আমি আমার দলের খেলোয়াড়দের সব সময় বলতাম, কালকের ম্যাচ নিয়ে ভাবো। কীভাবে কালকের ম্যাচ জেতা যায় সে ব্যাপারে পরিকল্পনা করো। আমার এই দর্শন তারেদকে দারুণভাবে প্রভাবিত করত। আপনি যদি জানতে চান, আমার সফল ম্যানেজার হওয়ার গোপন রহস্য কী তাহলে আমি বলব এই দর্শনই (পেছনে না তাকানো) আমাকে ম্যানেজার হিসেবে সফল করেছে। কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রধান ব্যাক্তিও যদি আমার এই দর্শন অনুসরণ করেন তবে আমার বিশ্বাস তিনিও পেশাজীবনে সফল হবেন।

সি : আমরা দেখেছি, আপনি সবসময় তরুণ প্রতিভাবান ফুটবলারদের নিয়ে দল গঠন করতেন। এখন যদি আপনাকে একটি ‘বিজনেস টিম’ গঠন করতে বলা হয়, আপনি কাদের প্রাধান্য দেবেন?

ফা : আমি অবশ্যই তাঁদেরকে নিয়ে টিম সাজাব যাদের মধ্যে রয়েছে উদ্যেম এবং একাগ্রতা। যাঁরা ভালো কিছু করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবে এবং পরাজয়েও কখনো মুষড়ে পড়বে না তাঁদেরকেই আমি খুঁজে নেব। আমি যখন তাঁদের সাক্ষাৎকার নেব তখন অবশ্যই খেয়াল রাখব তাঁরা কীভাবে চেয়ারে বসছে, কীভাবে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াচ্ছে, কীভাবে কথা বলছে, কণ্ঠের মধ্যে কতটা দৃঢ়তা রয়েছে ইত্যাদি।

সি : কাজের ব্যাপারে সৎ থাকা যেকোনো প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজারের জন্যই জরুরি, বিশেষত যারা তরুণ ম্যানেজার। ব্যাপারটাকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন ?

ফা : শুধু ম্যানেজান নয়, কাজের প্রতি নৈতিক থাকা প্রত্যেক টিম মেম্বারের জন্যই জরুরি। জীবনে সফল হতে হলে অবশ্যই কাজের প্রতি নীতিবান থাকতে হবে। অনেক প্রতিভাবান ব্যাক্তিকে দেখেছি যারা কর্মক্ষেত্রে নৈতিক ছিলেন না বলে কখনো সফল হতে পারেননি। আমি অনেক ভাগ্যবান যে আমার দলের প্রত্যেক খেলোয়াড়ই ছিল কঠোর পরিশ্রমী এবং নীতিবান।

সি : এবার লিডারদের ব্যাপারে একটু জানতে চাই। লিডার কী জন্ম নেয়, নাকি তৈরি হয়?

ফা : এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, কিছু কিছু মানুষ ‘নেতা’ হিসেবেই জন্ম নেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে নেলসন ম্যান্ডেলার নাম। বার কয়েক তাঁকে সামনে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। তবে নিজের ব্যাপারে আমি বলব, আমি সামান্য কিছু গুণ নিয়ে জন্ম নিয়েছি আর বাকিগুলো আয়ত্ব করেছি। জীবনের এ দীর্ঘ যাত্রাপথ আসলে শেখার পথ। চলতে চলতে আমি শিখেছি কীভাবে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয়, কীভাবে সংগঠন চালাতে হয়, কীভাবে মানুষকে ম্যানেজ করে চলতে হয় ইত্যাদি। কেউ যদি নেতা হতে চায় কিংবা কেউ যদি ম্যানেজার হতে চায় তবে প্রত্যেককেই কোনো না কোনো বিষয় আয়ত্বে আনতেই হবে।

সি : আমেরিকার বেশিরভাগ ক্লাবের ম্যানেজারদের একটা কথা বলতে শোনা যায় যে, খোলোয়াড়রা একটা পর্যায়ে যাওয়ার পর আর কোচদের কথা শুনতে চায় না, তারা নিজেরাই নিজেদের অভিবাবক হয়ে ওঠে। নিজের ইচ্ছামতো সিদ্ধান্ত নেয়। অথচ আপনার ক্ষেত্রে ব্যাতিক্রম। বছরের পর বছর ধরে খেলোয়াড়রা আপনার কথা শুনেছে, আপনার নেতৃত্ব মেনে নিয়েছে। এটা কীভাবে সম্ভব করতে পেরেছিলেন?

ফা : আমি দলের সকল খেলোয়াড় এবং কোচকে সাথে নিয়ে আলোচনা করতাম। কখনো তাদের ওপর কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতাম না। তাদেরকে শুধু আমার পরিকল্পনার কথা জানাতাম। কারণ আমি জানি, কোনো মানুষই দিনের পর দিন শুধু নির্দেশনামূলক একঘেয়েমি কথা শুনতে পছন্দ করবে না। আমি তাই তাদেরকে নিয়ে কখনো কখনো ওপেরা দেখতে যেতাম। পরদিন তাদের সাথে সেই অনুষ্ঠানের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করতাম। বলতাম, অর্কেস্ট্রার সুর কেমন ছিল, পরিবেশনা কেমন ছিল, পাত্র-পাত্রীদের অভিনয় কেমন ছিল ইত্যাদি। তারপর বলতাম, এর নাম টিমওয়ার্ক। টিমওয়ার্ক ছাড়া কোনো দল জয়ী হতে পারে না।

সি : ম্যানেজারদেরকে নাকি একটা একটা করে দিন ম্যানেজ করে চলতে হয়। অর্থাৎ আজকের দিন ভালোভাবে অতিবাহিত করতে পারলেই তাদের হাফ ছেড়ে বাঁচার উপায় নেই, তাঁকে ভাবতে হয় পরের দিন নিয়েও। আপনি দীর্ঘ সময় একটি ফুটবল ক্লাবে এই দায়িত্ব পালন করে এসেছেন। কীভাবে ভারসাম্য রক্ষা করতেন?

28-2ফা : আমার জীবনের একটা প্রধান দর্শন হচ্ছে, ভিত্তি তৈরি করা। যেকোনো কাঠামো তৈরির জন্য আগে দরকার শক্তিশালী ভিত্তি। ভিত মজবুত না হলে কখনো কাঠামো দাঁড়াবে না। অল্প আঘাতেই ভেঙে যাবে। আমি যে ক্লাবের ম্যানেজার ছিলাম সেই ক্লাব ছিল একটা কাঠামো। আর এর ভিত্তি ছিল এর খেলোয়াড়রা। আমি আমার সমস্ত শ্রম ঢেলেছি শুধু এই ভিত্তি গড়ার কাজে। ফলে কাঠামোটা টিকে গেছে। আপনি যদি এখন কোনো ব্যাবসায়িক কাঠামো দাঁড় করাতে চান তবে আপনাকে অবশ্যই আপনার ভিত্তির দিকে নজর দিতে হবে। কাদেরকে নিয়ে আপনি কাঠামো তৈরি করতে চাচ্ছেন তাদের দিকে নজর দিন। তাদের মনোবল বাড়ান, কঠোর পরিশ্রমী হতে উদ্বুদ্ধ করুন এবং লংটার্ম লক্ষ্য নির্ধারণ করে দিন।

সি : এবার জানতে চাই, লিডার ও ম্যানেজারের মধ্যে পার্থক্য কী?

ফা : আমার মনে হয় নেতার কাজ হচ্ছে, তার অনুসারীদের মধ্যে ‘আমার পক্ষেই সম্ভব’ এই বোধ জাগ্রত করা। একজন লিডার তার ব্যাক্তিত্ব ও মানিয়ে চলার ক্ষমতা দিয়ে এই বোধ জাগ্রত করতে পারেন। অপরদিকে, ম্যানেজারের কাজ হচ্ছে, সবকিছু ঠিকঠাকমতো চলছে কিনা তা তদারক করা। কোচ ঠিকমতো তার দায়িত্ব পালন করছে কিনা সেটা যেমন তাকে দেখতে হয় তেমনি খেলোয়াড়রা ঠিকমতো কোচের কথানুযায়ী অনুশীলন করছে কিনা সেটাও দেখতে হয়। মোটাদাগে বলতে গেলে এই হচ্ছে নেতা ও ব্যবস্খাপকের মধ্যে পার্থক্য।

সি : বোঝা যাচ্ছে, ম্যানেজারের দায়িত্ব একটু বেশি কঠিন। আপনি কীভাবে দিনের পর দিন এই দায়িত্ব পালন করে গেছেন?

ফা : এই কঠিন কাজটি করতে পেরেছি বলেই আজ আপনারা আমাকে সফল বলছেন। আমি প্রতিদিন সকাল সাতটার মধ্যে খোলোয়াড়দের থাকার কোয়ার্টারে হাজির হতাম। তাদের প্রত্যেকের কূশল জিজ্ঞাসা করতাম, কেউ ইনজুরিতে থাকলে তার স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা করতাম, তাদের পারিবারিক সমস্যা নিয়েও আলোচনা করতাম। আমি মনে করি আমার এইসব কাজই আমাকে ম্যানেজার হিসেবে সাফল্য এনে দিয়েছে।

হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত

Sharing is caring!

Leave a Comment