‘ডিজিটাল মার্কেটিং মানে শুধু ফেসবুক নয়’

‘ডিজিটাল মার্কেটিং মানে শুধু ফেসবুক নয়’

  • উদ্যোক্তা ডেস্ক

শুরুটা ফ্রিল্যান্সিং দিয়ে হলেও মাত্র একটা কাজ করেই তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন আসন্ন সময়ে সম্ভাবনার জায়গা। সেখানেই মেধা আর পরিশ্রম দিয়ে নিজেকে গড়ার পাশাপাশি গড়ে নিয়েছেন ক্যারিয়ারের শক্ত অবস্থান। ক্ষণিকের জীবনে ঘটে যাওয়া অনেকগুলো চাপও তাকে দমাতে পারেনি। জীবন যুদ্ধে হার না মানা এই তরুণ হচ্ছেন ডিজিটাল মার্কেটিং এক্সপার্ট মশিউর মন্টি। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে ডিজিটাল মার্কেটিং খাতের বিস্তারিত তথ্যসহ তাঁর সফল হওয়ার গল্প। 


: ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে কীভাবে আসলেন?

মশিউর মন্টি: ডিজিটাল মার্কেটিং এ আসাটার পেছনে আসলে অনেক গল্প আছে। আমি নারায়ণগঞ্জের মধ্যবিত্ত ঘর থেকে উঠে আসা সন্তান। ২০১০ সালে বাবা মারা যাওয়ার পর চাকরির জন্য দৌড়ঝাপ শুরু হয়। তখন আমি বুঝতে পারলাম নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা এসে ২০/২৫ হাজার টাকার বেতন দিয়ে কিছু করা সম্ভব না। যেহেতু আমি আগেই গ্রাফিক্স ডিজাইনিংয়ের ওপর একটা কোর্স করেছিলাম।

তখন ভাবলাম, তাহলে আমি কেন এটাকে কাজে লাগাচ্ছি না। এরপর ওডেস্কে রেজিস্ট্রেশন করে কাজ খোঁজা শুরু করলাম। যখন একটি কাজ সম্পন্ন করলাম, তখন বুঝতে পারলাম আমাদের দেশে অনেক বড় একটা খাত ছেড়ে যাচ্ছে। সেটা হচ্ছে অনলাইন মার্কেটিং। এরপর অনলাইনে সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং নিয়ে কাজ করা শুরু করলাম। ওই সময় গ্রাফিক্স ডিজাইনের চেয়ে দেখলাম ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের চাহিদা অনেক বেশি।

: আপনি এখন কী করছেন? 

মশিউর মন্টি: আমি এখন বিডিজবস ট্রেনিং সেন্টারে ডিজিটাল মার্কেটিং নিয়ে ক্লাস নিচ্ছি। এছাড়াও বিডিজবস ট্রেনিংয়ের হেড অব ডিজিটাল মার্কেটিং এবং আজকের ডিল’র হেড অব অনলাইন প্রমোশনের দায়িত্ব পালন করছি। এছাড়াও সঙ্গীতশিল্পী মিলার অনলাইন ব্র্যান্ড ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। পাশাপাশি আমার যুক্তরাষ্ট্রের একজন গ্রাহক আছে। তাদের ডিজিটাল মার্কেটিং নিয়েও কাজ করছি। এছাড়াও আইসিটি মন্ত্রণালয়ের লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং প্রকল্পের রংপুর বিভাগের মেন্টর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছি। এছাড়াও নিজের ওয়েবসাইটে ডিজিটাল মার্কেটিং নিয়ে নিয়মিত ব্লগ আর্টিকেল লিখছি।

: ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে কাজ করতে কোথায় কোথায় সমস্যা মনে হচ্ছে?

মশিউর মন্টি: আমাদের দেশে কাজ করতে কোনো সমস্যা নাই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যারা কাজ করছে তাদের। এদের মধ্যে দুইটা লেভেল আছে। একটা হচ্ছে যারা একদম নতুন, উদ্যোক্তা বলতে পারেন। যারা ই-কমার্স নিয়ে কাজ করছেন, সেখানে উচ্চ পর্যায়ে বা মালিকানায় আছেন, তাদের মধ্যে ডিজিটাল মার্কেটিং এর একটি ভুল ধারণা হচ্ছে যে, তারা ভাবে শুধুমাত্র ফেসবুকে অ্যাড দিয়েই ব্যবসাটা হয়ে যাবে। তারা ভবিষ্যৎ নিয়েও ভাবে না বা বর্তমান নিয়েও কোনো গবেষণা করে না। এই বিষয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। আরেকটা হচ্ছে বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো যখন কোনো ডিজিটাল মার্কেটিং এক্সপার্ট নিয়োগ দিতে যাচ্ছে, তখন তারা আগে জিজ্ঞেস করছে ফেসবুকে একাউন্ট আছে কিনা? ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া হয় কিনা, দিলে কেমন পোস্ট? এইসব। এটা দিয়েই তারা নির্বাচন করছে যে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের জন্য এই ব্যক্তি সঠিক। কিন্তু তারা নিজেরাই জানে না যে, আসলে ডিজিটাল মার্কেটিং মানে কী? কোন কোন মাধ্যম থেকে এটা করা সম্ভব? তাই সে শুধু ফেসবুককে কেন্দ্র করেই প্রশ্ন করছে। আর এই ক্ষেত্রে নতুনরাও ভাবছে শুধুমাত্র ফেসবুক নিয়ে একটু দক্ষতা থাকলেই ডিজিটাল মার্কেটিং নিয়ে কাজ করা যাবে। তাহলে একটু দেখেন, নতুন উদ্যোক্তা, চাকরিদাতা এবং যে কাজ করবে তিনজনের কেউই শিখতে চাইছে না যে ডিজিটাল মার্কেটিং কী?

: এসব ক্ষেত্রে কি কি সমস্যা হতে পারে? 

মশিউর মন্টি: এই না শেখার ক্ষেত্রে আমি একটা উদাহরণ দিতে পারি। আপনি যদি একটু শেষ বছরের দিকে তাকান। যেই ট্রেন্ডটা ছিল তা হচ্ছে উইমেন ক্লথের বিজনেস। ভারতীয় কাপড়গুলো অনলাইনে অনেক বেশি বিক্রি হয়েছে এবং এটা নিয়েই অনেকে কাজ করেছে। একই সাথে রেপ্লিকা ঘড়ির বাজারও অনেক ভালো ছিল। যখনই ফেসবুক রেপ্লিকা পোস্ট নিয়ে নিষেধাজ্ঞা দিলো এরপর কিন্তু আর কেউ পোস্ট দিতে পারেননি। সো যারা ওইসময় এসব বিষয় নিয়ে কোনো পরিকল্পনা করেননি তারা কিন্তু এখন আর রেপ্লিকা কোনো পণ্যের বিজ্ঞাপণ দিয়ে ব্যবসা করতে পারছে না। ওই ৬ মাস ব্যবসা করার সময় তারা কিন্তু তখন ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবেন নাই, কোনো পরিকল্পনা করেন নাই। এই জন্যই পরিকল্পনার অভাবে তারা ওই একবছরের জন্য যেমন বিনিয়োগ করে অর্থ নষ্ট করছেন তেমনি ক্যারিয়ারেরও ক্ষতি করছেন।

: আপনার পথচলার ক্ষেত্রে কোন কোন বাধার সম্মুখীন হয়েছন? 

মশিউর মন্টি: আপনি যে কোনো কাজ করতে যান, আপনাকে সফল হতে হলে কিন্তু বাধা অতিক্রম করতে হবেই। আর বিশেষ করে আমাদের লোকাল মার্কেটে তো এইটা অনেক বেশি। ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে কাজ করতে করতে আমরা যখন বুঝতে পারি এখন আমাদের কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে, দেশের জন্য কিছু করতে পারবো। তখন লোকাল মার্কেটের দিকে ঝোঁক বাড়ে। কিন্তু লোকাল মার্কেটে থাকা সিনিয়ররা নতুনদের সেই জায়গা দিতে চান না। তাদেরকে কোনোভাবেই উঠতে না দিয়ে, পারলে তাদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিজের নাম কামানো, আয় বাড়ানোর চেষ্টা করে। এটা একটা বাধা বলে আমি মনে করি। আর এমনও হতে পারে আমরা যখন সিনিয়র হচ্ছি তখন আমাদের মধ্যেও এই মনোভাবটা থেকে যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়য়ের র‌্যাগিংয়ের  মতো। যখন নতুন ছাত্রটা র‌্যাগিংয়ের শিকার হয়, পরবর্তীতে সেও নতুনদের ক্ষেত্রে ঐ একই কাজ করে। আমরা যদি আমাদের সাইট থেকে এসব সমস্যাগুলো বন্ধের উদ্যোগ নেই, তাহলে বোধহয় এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।

: এই খাতের সম্ভাবনা কী?

মশিউর মন্টি: ডিজিটাল মার্কেটিং খাতে প্রচুর সম্ভাবনা আছে। সরকার এই খাতে প্রচুর পরিমাণ বিনিয়োগ করছে, কাজ করছে। সেই সাথে আরও যা করতে হবে, তা হলো মানসিক চিন্তা ভাবনা পরিবর্তন করা। তাদের মধ্যে একটা ধারণা কাজ করে যে অল্প সময়ে ফ্রিল্যান্সিং করে আয় করা সম্ভব। অনলাইনে ব্যবসায় নেমেই তারা আয় করতে পারবে। এই ভুল ধারণাগুলো তাদের কাছ থেকে দূর করতে হবে। এই কাজটা করতে পারলে আমরা অনেক এগিয়ে যেতে পারবো।

তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ফ্রিল্যান্সিং, ই-কমার্স নিয়ে আমাদের প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ইতিমধ্যেই অনেক কাজ শুরু করে দিয়েছেন। বর্তমানে লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং প্রজেক্টে তিনি এমন নিয়ম করেছেন যে, যারা প্রশিক্ষণ নিচ্ছে তাদেরকে এই প্রশিক্ষণ চলাকালীন সময়েই আয় করে দেখাতে হবে। না হয় তারা চাকরিক্ষেত্রে কোনো ধরনের সহায়তা পাবে না। সরকার যেহেতু এই খাতে এখন অনেক বেশি নজর দিচ্ছে, তাই এখন যদি আমরা একটু স্মার্ট হয়ে কাজ করি তাহলে ভালো কিছু করা সম্ভব।

: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? 

মশিউর মন্টি: আমার ভবিষ্যত পরিকল্পনা হচ্ছে, আমি স্থানীয় মার্কেটের জন্য এমন কিছু করতে চাই যেন আর ১০ জন মানুষ ভালো কিছু কাজের জন্য আমাকে চেনে। যেন আমার কারণে তারা ভালো কিছু লাভ করতে পারে। যেমন; তাদের উপার্জন করতে সাহায্য করে, তাদেরকে সামনে উঠে আসতে সাহায্য করে এমন কিছু কাজ করতে চাই। কারণ আমি যেহেতু মধ্যবিত্ত ঘর থেকে এসেছি, আমি জানি এমন সংসারে অনেকেই আছেন যাদের দক্ষতা আছে, ইচ্ছে আছে বা কঠোর পরিশ্রম করছে কিন্তু যথোপযুক্ত ফলাফল পান না। অনেকেই দেখা যায় কষ্ট করে ট্রেনিংয়ের টাকা জমান। পরে দেখা যায় সেই কষ্টের টাকায় এমন জায়গায় ট্রেনিং করেন, যা আসলে তার ক্যারিয়ারের কোনো কাজে আসে না। সেই বিষয়গুলোকে বেইজ করে আসলে ওই মানুষগুলোর জন্য কিছু করতে চাইছি। তার মানে কিন্তু এই না আমি আমার সবকিছু বিলিয়ে দিতে পারবো। তাই আমি কিছু ব্লগিং করি, যা সম্পূর্ণ বাংলায় করার চেষ্টা করি। আমাকে কেউ ফেসবুকে নক করলে, ফোন করলে আমি তাদের এই বিষয়ে সাহায্য করার চেষ্টা করি। এছাড়া আমাদের ট্রেইনার লেভেলের একটা পরিবর্তন খুব দরকার। কারণ সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের ট্রেইনারকে নিয়োগ দেন। কিন্তু তারা কতটুকু যোগ্য সেটা কিন্তু কেউ দেখেন না। তাই শহর থেকে একদম প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত প্রশিক্ষকদের দক্ষ করে তোলার কাজ করতে চাই।

সূত্র: প্রিয়.কমfavicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment