জীবনের শেষ বক্তৃতায় যা বলেছেন র‌্যান্ডি পশ

জীবনের শেষ বক্তৃতায় যা বলেছেন র‌্যান্ডি পশ

  • লিডারশিপ ডেস্ক

পুরো নাম র‌্যান্ডফ ফ্রেডেরিক পশ, তবে ‘র‌্যান্ডি পশ ’ নামেই তিনি পৃথিবীব্যাপী পরিচিত। ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের পেনিসিলভানিয়ায় অবস্থিত কার্নেগি মেলন ইউনিভার্সিটির ‘কম্পিউটার বিজ্ঞান’ বিষয়ের অধ্যাপক। অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার পর ডাক্তার যখন বললেন তাঁর আয়ু বড়জোড় তিন থেকে ছয় মাস, তখন তিনি কার্নেগি মেলন ইউনিভার্সিটিতে ‘দ্য লাস্ট লেকচার ’ শিরোনামে এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে একটি বক্তৃতা দেন। ২০০৭ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর প্রদত্ত সেই বক্তৃতা পরবর্তীতে বই আকারে প্রকাশিত হয় এবং নিউ ইয়র্ক টাইমস বেস্ট সেলার বইয়ের তালিকায় সেটি স্থান পায়। ১৯৬০ সালের ২৩ অক্টোবর জন্ম নেওয়া র‌্যান্ডি পশ মারা যান ২৫ জুলাই, ২০০৮ সালে। তাঁর সেই বিখ্যাত বক্তৃতার সংক্ষেপিত অংশ প্রমিনেন্টের পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হলো।


এই মঞ্চে এভাবে আসতে পারাটা সত্যিই এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। উপস্থাপক এতক্ষণ অনেক কিছুই বললেন আমার সম্পর্কে, তবে যেটা বলেননি সেটা হলো, আজকের এই বক্তৃতাই আমার জীবনের শেষ বক্তৃতা—দ্য লাস্ট লেকচার! পৃথিবী থেকে বিদায় নেবার আগে শেষবারের মতো কিছু বলতে পারার এই সুযোগকে আপনি আর কী নাম দিতে পারেন? এখানে হয়ত এমন অনেকেই আছেন যারা পুরনো ইতিহাস জানেন না, তারা হয়ত ভাবছেন যে কী হচ্ছে এখানে? তাদের জন্য বলি, আমার সিটি স্ক্যান রিপোর্ট বলছে যে আমার যকৃতে দশটি টিউমার ধরা পড়েছে। ডাক্তাররা বলেছেন, এই পৃথিবীতে আমার বেঁচে থাকার আয়ু মাত্র তিন থেকে ছয় মাস। তো এই হচ্ছে ব্যাপার!

আমার অসুস্থতার ব্যাপারটি জেনে আপনারা কি হতাশ হলেন? আমি সত্যিই খুব দুঃখিত আপনাদেরকে হতাশ করার জন্য। তবে আমাকে দেখে নিশ্চয় বুঝতে পারছেন যে বিষণ্ন কিংবা মনমরা একটা চেহারা নিয়ে আমি এখানে আসিনি, যদিও সেভাবে আসাই হয়ত স্বাভাবিক ছিল। যাহোক, বাদ দিন সেসব কথা। আমি আমার ক্যান্সার-সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ে আর কথা বাড়াতে চাইছি না, অনেক হয়েছে। আমি আর আগ্রহী নই। আমি এমন কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাই না, যা আমার শৈশবে দেখা স্বপ্নগুলোর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।

স্ত্রীর সঙ্গে র‌্যান্ডি পশ। ছবি: পিটসবার্গ ম্যাগাজিন

তো আমাদের ছোটবেলার স্বপ্নগুলো কী ছিল? আমার তালিকার সঙ্গে আপনারা হয়ত একমত না-ও হতে পারেন। আমার স্বপ্ন ছিল জাতীয় দলের হয়ে ফুটবল খেলা, তারপর এনসাইক্লোপিডিয়ায় প্রবন্ধ লেখা কিংবা ক্যাপ্টেন ক্রিকের মতো হয়ে যাওয়া। সেই ছোটবেলায় আমি খুব চেয়েছিলাম, বিনোদন পার্কের সবচেয়ে সেরা পুরস্কারটা হাতে পেতে। চেয়েছিলাম, ডিজনির সঙ্গে কল্পনার কারিগর হতে। এসব কোনোটি হওয়ারই তেমন সম্ভাবনা ছিল না আমার। কিন্তু যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা হচ্ছে, স্বপ্ন দেখা ও স্বপ্নকে লালন করা। আমি কখনোই কোনো মহাকাশচারী হতে চাই না, কারণ আমার ছিল অনেক বেশি পাওয়ারের চশমা। আপনারা জানেন, মহাকাশচারীরা চশমা পরে না। আমি তাই কোনো মহাকাশযানের মালিকও হতে চাই না। আমি শুধু চেয়েছিলাম এ বিশাল মহাশূন্যে ভাসতে।

নাসার একজন মহাকাশচারী থেকে শুরু করে ডিজনির কল্পনার কারিগর হতে চাওয়ার স্বপ্ন পর্যন্ত সব স্বপ্নই কীভাবে কীভাবে যেন ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল। যেন প্রতিটি স্বপ্নের সামনেই রয়েছে ইটের বাধা। আর আমার সবকিছু দিয়ে চেষ্টা করতে করতেই শিখেছি যে স্বপ্ন পূরণের পথে এই ইটের দেয়ালগুলো থাকারও একটা কারণ আছে। কেবল বাধা দেওয়ার জন্যই দেয়াগুলো তৈরি হয় না। বরং আমরা কতটা দৃঢ় ও আন্তরিকভাবে স্বপ্ন পূরণের জন্য চেষ্টা করি সেটা পরখ করতেই দেয়ালগুলো বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দেয়ালগুলো দাঁড়িয়ে থাকে তাদের জন্যও যারা স্বপ্ন পূরণের জন্য সেভাবে আগ্রহী নয়।

মা, বাবা ও বোনের সঙ্গে কিশোর র‌্যান্ডি পশ। ছবি: পিটসবার্গ ম্যাগাজিন

যা বলছিলাম, জাতীয় ফুটবল দলে খেলতে যাওয়ার স্বপ্ন আমার পূরণ হয়নি। তাতে ক্ষতি নেই। কিন্তু সেই স্বপ্ন থেকে আমি আরও বড় কিছু শিখেছি। আমি স্বপ্ন পূরণে ব্যর্থ হওয়ার মধ্য দিয়ে আরও নতুন কিছু অর্জনের স্বপ্ন দেখতে শিখেছি।

এখন একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলি। আপনি হয়ত কোথাও খারাপ কিছু করছেন, কিন্তু আপনাকে কেউ কিছু বলছে না, তখন বুঝবেন যে আপনি খুব খারাপ একটি জায়গায় কাজ করছেন। সমালোচককে ভালোবাসুন। কারণ সমালোচকরা আপনার ত্রুটি প্রকাশের পাশাপাশি আপনাকে জানিয়ে দেয় যে তারা আপনাকে কতটা ভালোবাসে এবং খেয়াল রাখে।

আমি একটা জিনিস খুব বিশ্বাস করি, সেটা হচ্ছে ‘হেড ফেক’ কিংবা ঘোরালো বা পরোক্ষভাবে শেখা। এটা আমাদের জীবনে খুব জরুরি। যেমন ধরুন ফুটবল খেলা। আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে ফুটবল মাঠে পাঠাই শুধুই কী খেলা শেখার জন্য? নিশ্চয় না। আমরা চাই, তারা দলের মধ্যে সংঘবদ্ধ হয়ে কাজ করা শিখুক, খেলায় দক্ষতা অর্জন করুক এবং জীবনের সব ক্ষেত্রে অধ্যবসায় শিখুক।

র‌্যান্ডি পশ। ছবি: টাইম ম্যাগাজিন

আমাদের একটা প্রজেক্টের নাম ছিল ‘এলিস’। আমরা এটি নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেছিলাম। কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শেখার এটি একটি অসাধারণ কৌশল। একটু আগে যে ‘হেড ফেক’ এর কথা বলছিলাম সেটা আবার বলতে চাই। কারণ, কাউকে কিছু শেখানোর সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি হচ্ছে তাকে এমনভাবে শেখানো, যেন তার মনে হয় সে অন্যকিছু শিখছে। এলিস ছিল সেরকম একটি কৌশল। এর মধ্য দিয়ে শিশুরা আসলে ছবি বা গেমস বানানো শিখছিল না, তারা শিখছিল প্রোগ্রামিং। ‘এলিসে’র নতুন ভার্সনটা আরও অভিনব, আমি সেখানে যা দেখছি তা হলো লাখ লাখ শিশু খেলার আনন্দের মধ্য দিয়ে খুব কঠিন কিছু শিখছে।

আমি আমার বক্তৃতার প্রায় শেষের দিকে চলে এসেছি। শেষে শুধু এটুকু বলতে চাই, আপনার জীবনের সামনে থাকবে নানা পথ। সঠিক পথটি আপনাকেই বেছে নিতে হবে। কখনোই হতাশ হবেন না। হাল ছাড়বেন না। আপনার আন্তরিকতা ও সত্যবাদিতা দিয়ে এগিয়ে যান মানুষকে সাহায্য করার জন্য। জীবনে নানা অপ্রাপ্তি থাকবে, তাই নিয়ে জীবনের কাছে নালিশ করবেন না কখনো। বরং যে জীবন যাপন করছেন তার জন্য কৃতজ্ঞা প্রকাশ করুন। আর প্রাণপন পরিশ্রম করে যান স্বপ্ন পূরণের জন্য।

উপদেশ একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে, তারপরও বলি। শেষ উপদেশই তো! সব সময় অন্যের ভালো গুণটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করবেন। পৃথিবীতে এমন কেউ নেই, যার সবটাই খারাপ। প্রত্যেকেরই ভালো ও খারাপ দিক আছে। তাই তার ভালো দিকটি খুঁজে পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করুন।

সূত্র: কার্নেগি মেলন ইউনিভার্সিটির ইউটিউব চ্যানেল। ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ : মারুফ ইসলাম

Sharing is caring!

Leave a Comment