গল্পটা একজন সামুসা বিক্রেতা ও তাঁর এমবিএ ডিগ্রিধারী ছেলের

গল্পটা একজন সামুসা বিক্রেতা ও তাঁর এমবিএ ডিগ্রিধারী ছেলের

  • লিডারশিপ ডেস্ক

ভারতের এক শহরে সামুসা বিক্রি করেন বানওয়ারিলাল। একটি ঠেলাগাড়িতে করে তিনি প্রতিদিন অন্তত ৫০০ সামুসা বিক্রি করেন। গত ৩০ বছর ধরে মানুষ তাঁর সামুসা খাচ্ছে। একজন সামুসাবিক্রেতা হিসেবে তিনি যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন তা বিস্ময়কর! তাঁর জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ ভেজালমুক্ত, স্বাস্থকর সামুসা তৈরি করা। তিনি কখনোই পোড়া তেলে সামুসা ভাজেন না। উপরন্তু তিনি সামুসার সঙ্গে বিনামূল্যে চাটনি দেন। আর দিনশেষে যেসব সামুসা অবিক্রিত থেকে যায়, সেসব তিনি গরবী-দুঃখী মানুষ ও পথের কুকুর-বিড়ালদের মাঝে বিতরণ করেন। বাসি সামুসা তিনি কখনোই পরেরদিন বিক্রি করেন না। তাঁর এই সততাই তাঁকে বিস্ময়কর সাফল্য এনে দিয়েছে। এনে দিয়েছে বিপুল অর্থ ও প্রতিপত্তি। সামুসা বিক্রির অর্থ দিয়েই তিনি তাঁর ছেলেকে নদিয়ার একটি বেসরকারি কলেজ থেকে ব্যচেলর অব টেকনোলজি (বিটেক) ও এমবিএ বিষয়ে পড়িয়েছেন।

বানওয়ারিলালের ছেলের নাম রোহিত। রোহিত সম্প্রতি এমবিএ ডিগ্রি সম্পন্ন করেছে, কিন্তু কোনো চাকরি জোটাতে পারেনি। ফিরে এসেছে বাড়িতে। এখন বাবার ব্যবসার মুনাফা থেকে টাকা নিয়ে নিজের খরচ চালায়। প্রথম দিকে বানওয়ারিলাল ছেলেকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন তার ব্যবসার সঙ্গী হওয়ার। কিন্তু সমুসা বিক্রিকে ‘নিকৃষ্ট কাজ’ বলে বাবার প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি রোহিত। তার কিছুদিন পর সে অবশ্য বাবার সঙ্গে ব্যবসায় যুক্ত হয়।

রোহিত যখন এমবিএ বিষয়ে পড়ছিল, তখন তাকে ‘ব্যবসায়িক মন্দা’ সম্পর্কে প্রচুর পড়ালেখা করতে হয়েছে। সে জেনেছে যে ব্যবসায়িক মন্দা আসে বৈশ্বিক অর্থনীতি থেকে। সে আরও জেনেছে, মন্দার কারণে কীভাবে চাকরির বাজার সংকুচিত হয় ও বেকারত্ব বাড়ে। সুতরাং রোহিত মনে মনে ভাবল যে, ব্যবসায়িক মন্দার বিষয়টি তার বাবাকে বোঝানো উচিত। তাকে বলা দরকার, বাবা, তোমার সমুসার ব্যবসাটি বড়ই ঝুঁকির মধ্যে আছে! তোমার এখন উচিত, মুনাফা ঠিক রাখার জন্য ব্যয়সংকোচন নীতি অবলম্বন করা।

ছেলের কথা শুনে বানওয়ারিলাল খুব মুগ্ধ হলেন। ছেলের তো ব্যবসা সম্পর্কে অনেক জ্ঞানবিদ্যা হয়েছে! তিনি ছেলের উপদেশকে বেশ আমলে নিলেন। পরদিন ছেলে পরামর্শ দিল—‘বাবা, সামুসা ভাজার তেলের মধ্যে ২০ শতাংশ পোড়া তেল দাও আর বাকি ৮০ শতাংশ ভালো তেল দাও। এতে তোমার খরচ কিছুটা কমবে।’ বানওয়ারিলাল ছেলের পরামর্শ মোতাবেক তাই করলেন। ক্রেতারা কোনো তফাৎই ধরতে পারল না। সেদিও ৫০০ সামুসা বিক্রি হয়ে গেল।

মুনাফা অর্জনের এই কৌশল রোহিতকে খুব অনুপ্রাণিত করলো। পরদিন সে তার বাবাকে বলল, বাবা, পোড়া তেলের পরিমাণ বাড়িয়ে দাও। ওটা ৩০ শতাংশ করে দাও। আর এত্তগুলো ফ্রি চাটনি দেওয়ার দরকার কী! চাটনির পরিমাণ একটু কমিয়ে দাও।

ওইদিন ৪০০ সামুসা বিক্রি হলো। বাকি ১০০ সমুসা পথের কুকুর-বিড়ালের মধ্যে বিলি করতে হলো বানওয়ারিলালকে। রোহিত তার বাবাকে বলল, আমি যা ধারনা করেছিলাম, তাই কিন্তু ঘটছে বাবা। মন্দা ঠিকই আমাদের ব্যবসার ওপর প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। সুতরাং আমাদের আরও ব্যয় কমানো উচিত। শোনো, প্রতিদিনকার বেঁচে যাওয়া সামুসা যে গরীব-দুঃখী মানুষের মাঝে বিতরণ করো, সেটার দরকার নেই। আমরা অগুলোকে পুণরায় তেলে ভাজব এবং পরদিন বিক্রি করব। আর যে তেলে ভাজব, সেখানে ৪০ শতাংশ পোড়া তেল ব্যবহার করব। তাহলে আমাদের খরচ অনেক কমে যাবে। সামুসাও বানাব ৪০০, তাহলে সব বিক্রি হয়ে যাবে। অতিরিক্ত নষ্ট হবে না।

পরদিন অবশ্য ৪০০ সামুসাই বিক্রি হয়ে গেল, কিন্তু ক্রেতারা আগের স্বাদ পেল না। বানওয়ারিলাল ভাবলেন, ছেলে অনেক লেখাপড়া শিখেছে। সে নিশ্চয় অনেক কিছু জানে। তার এই খরচ বাঁচানোর কৌশলটা নিশ্চয় বিরাট আধুনিক একটা ব্যাপার।

এবার তেলের মধ্যে ৫০ শতাংশ পোড়া তেল ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিল রোহিত। চাটনির মধ্যে থেকে মিষ্টি চাটনি বাদ দিল সে, শুধু গ্রিন চাটনি রাখল। আর সামুসা বানালো আগোর মতো ৪০০টি। সেদিন সামুসা বিক্রি হলো ৩০০টি। ক্রেতাদের চোখেমুখে অসন্তোষ।

রোহিত বলল, ‘অর্থনৈতিক মন্দা একেবারে জেঁকে বসেছে বাবা! সেজন্যই আমাদের ব্যবসা দিনকে দিন খারাপ হচ্ছে। শোনো, ওই বেঁচে যাওয়া সামুসা ফেলে দেওয়ার দরকার নেই। ওগুলো আরেকবার তেলে ভেজে আগামীকাল বিক্রি করব।’ এমবিএ ডিগ্রিধারী পুত্রের সঙ্গে দ্বিমত করতে পারলেন না বানওয়ারিলাল।

পরেরদিন ৫০ শতাংশ পোড়া তেল দিয়ে ২০০ সামুসা ভাজা হলো। আর আগের দিনের বাসি ১০০ সামুসা মিলে মোট ৩০০ সামুসা রাখা হলো বিক্রির জন্য। সেদিনও সব সামুসা বিক্রি হলো না। ১০০ সামুসা অবশিষ্ট রয়ে গেল।

রোহিত বলল, বাবা দেখেছ, মন্দা কীভাবে জেঁকে বসেছে! আসলে মানুষের পকেটে তো টাকাই নেই। তারা কিনবে কী করে! চলো, আজ আমরা ১০০ সামুসা বানাই। আর সামুসার সঙ্গে টিস্যু দেওয়ার প্রয়োজন নেই।

কিন্তু সেদিনও সব সামুসা বিক্রি হলো না। পঞ্চাশটি সামুসা রয়েই গেল।

‘অর্থনৈতিক মন্দা মানুষকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে, বাবা। মানুষের কোনো আয়-রোজগার নেই। আমাদের এখন এই ব্যবসা বন্ধ করে দিয়ে অন্যকিছু করার কথা ভাবা উচিত।’ রোহিত বলল তার বাবা বানওয়ারিলালকে।

বানওয়ারিলাল খুব রেগে গেলেন। চিৎকার করে বললেন, আমি জানি না, এমবিএর নামে তারা প্রতারণা শেখায় কি না! তোমাকে এমবিএ পড়াতে গিয়ে আমি আমার সমস্ত টাকা শেষ করেছি। গত তিরিশ বছরে আমি কখনো মন্দার মধ্যে পড়িনি। কিন্তু তোমার অধিক মুনাফার লোভ আর অর্থনৈতিক মন্দার বিদ্যার কারণে আমার ব্যবসাটা বন্ধ হয়ে গেল। তুমি বিদায় হও আমার ব্যবসা থেকে। আমি আমার ব্যবসাকে আবার আগের অবস্থায় নিয়ে যাব। তুমি চাইলে আমার দোকানে থালাবাসন ধোয়ার কাজে যোগ দিতে পারো। একজন এমবিএ ডিগ্রিধারী হিসেবে তুমি এটাই করতে পারো।

এরপর বানওয়ারিলাল আগের মতো সততার সঙ্গে ব্যবসা শুরু করেন এবং এক মাসের মধ্যে তাঁর সামুসা বিক্রির পরিমাণ আবারও ৬০০ ছাড়িয়ে যায়।

অর্থনৈতিক মন্দা আর কিছুই নয়—এটি মাত্রাতিরিক্ত ট্যাক্স আদায়ের জন্য সরকারের লোভ এবং ব্যবসায় মুনাফা বাড়ানোর জন্য ব্যবসায়ীদের লোভ। ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত মুনাফা করার লোভে গুনগত মানে ছাড় দেয় এবং নানাবিধ অসৎ পন্থা অবলম্বন করে। অনেক সময় উগ্র, অসচেতন কর্মীর জন্যও ব্যবসা ক্ষতির মুখে পড়ে। মন্দা মূলত সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে সরকার ও ব্যবসায়ীদের প্রতি একধরনের শাস্তি। মানুষ তাদের ব্যয় কমিয়ে সরকার ও ব্যবসায়ীদের এই শাস্তি দেয়।

সূত্র : কোরা ডটকম

ইংরেজি থেকে অনুবাদ : মারুফ ইসলাম

Sharing is caring!

Leave a Comment