২০ শিক্ষকের পরিবার

২০ শিক্ষকের পরিবার

  • নিউজ ডেস্ক

কলেজ শিক্ষক সাখাওয়াৎ হোসেনের (৪২) বাড়ি গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া গ্রামে। তার বাবা, চাচা-জেঠা, বোনসহ চার ভাই শিক্ষক। ভাইয়ের স্ত্রীদের পেশাও শিক্ষকতা। এমনকি শ্বশুর-শাশুড়িও শিক্ষক। সবমিলিয়ে তাঁর পরিবারে আছেন ২০জন শিক্ষক। পরিবারের সবাই শিক্ষক হওয়ার কারণে তিনি গর্ববোধ করেন। ঈদে ও বিভিন্ন পারিবারিক অনুষ্ঠান ছাড়াও সবাই মাসে একবার হলেও বৈঠকে বসেন।

সবাই শিক্ষক হওয়ার পেছনের গল্প শোনান সাখাওয়াৎ হোসেন- ‘ছোটবেলায় শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকদের পাঠদানে মুগ্ধ হতাম। তখন স্বপ্ন দেখতাম শিক্ষকতা করব। হয়েও গেলাম। এ ছাড়া সব সময় আমার শিক্ষক বাবা ও চাচা আমাকে শিক্ষক হতে প্রেরণা জুগিয়েছেন।’

১৯৯৪ সালে সাখাওয়াৎ হোসেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পাস করেন। এর পরের বছর ১৯৯৫ সালে তিনি গাইবান্ধা সদর উপজেলার হাজী ওসমান গনি ডিগ্রি কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। তার বাবা আলহাজ ফরিজ উদ্দিন সরকার। তিনি ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ১ নম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ১৯৯৫ সালে অবসর নেন।

পাঁচ ভাই, দুই বোনের মধ্যে সাখাওয়াৎ হোসেন দ্বিতীয়। ভাইদের মধ্যে তিনি সবার বড়। তার ভাই ও তাদের স্ত্রী এবং বোন ও বোনের স্বামীও শিক্ষক। সাখাওয়াৎ হোসেনের দ্বিতীয় ভাই শফিকুল ইসলাম বর্তমানে ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের কাইয়ারহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। শফিকুলের স্ত্রী রওশন আরা বেগম কঞ্চিপাড়া ১ নম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক। শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা নিজে যা শিখেছি, তা শিক্ষার্থীদের শেখাতে পারছি। শুধু পাঠদানই নয়; একজন মানুষের চরিত্র গঠনে পরামর্শ দেওয়ার সুযোগও শিক্ষকদের আছে। তাই এ পেশা ভালো লাগে।’

সাখাওয়াৎ হোসেনের তৃতীয় ভাই শহিদুজ্জামান ও তার স্ত্রী শাহনাজ বেগম ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক। ছোট ভাই শাহাদত হোসেন ফুলছড়ি উপজেলার ফজলুপুর ইউনিয়নের চরকৃষ্ণমণি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। শাহাদতের স্ত্রী সাবরিনা সুলতানা ফুলছড়ি উপজেলার মধ্যকঞ্চিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত।

এছাড়া সাখাওয়াৎ হোসেনের ছোট বোন নিলুফা ইয়াসমিন ফুলছড়ির কঞ্চিপাড়া ১ নম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। তার স্বামী মাহমুদুল হক গাইবান্ধা সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইন্সট্রাক্টর।

অপরদিকে মাহমুদুল হকের বাবা এনামুল হক গাইবান্ধা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ছিলেন। মা দিলরুবা বেগম ২০১৪ সালে গাইবান্ধা থানাপাড়ায় কলেজিয়েট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে অবসর নেন। মাহমুদুল হক বলেন, ‘শিক্ষকরা শিক্ষকের মর্যাদা বোঝেন। তাই খোঁজ নিয়েই আত্মীয়তা করি।’

শুধু তাই নয়; সাখাওয়াৎ হোসেন ২০০২ সালে এক শিক্ষিকাকে বিয়ে করেন। তার স্ত্রী মাহবুবা জেসমিন গাইবান্ধা সদর উপজেলার ঝিনেশ্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। তার শ্বশুর মুনছুর আলী সরকার তুলসীঘাট কাশিনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তিনি অবসর নেন ২০১১ সালে। তার শাশুড়ি জাহানারা বেগম গাইবান্ধা সদর উপজেলার বিষ্ণুপুর এসএমবি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ছিলেন। তিনি অবসর নেন গত বছর।

এক শিক্ষক পরিবার থেকে আরেক শিক্ষক পরিবারে কেমন লাগছে- প্রশ্ন করলে মাহবুবা জেসমিন বলেন, ‘আমি শিক্ষক পরিবারের মেয়ে। শিক্ষক পরিবারে বিয়ে হয়েছে। ভাবতে গর্ববোধ করি।’

এ ছাড়া সাখাওয়াৎ হোসেনের চাচা আলহাজ মজিবর রহমান ফুলছড়ি উপজেলার উড়িয়া ইউনিয়নের গুনভড়ি দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসর নেন। মজিবর রহমানের তিন ছেলেই শিক্ষক। এর মধ্যে রুহুল আমিন ও মাসুদুর রহমান প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, অপর ছেলে কামরুল হাসান কলেজ শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। মাসুদুরের স্ত্রী হুজ্জাতুন নাহারও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। কঞ্চিপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবু বক্কর সিদ্দিক মুন্না বলেন, ‘এক পরিবারে এত শিক্ষক দেশের অন্য কোথাও আছে কি-না আমার জানা নেই।’

শিক্ষকের বাবা আবার শিক্ষকের শ্বশুর কেমন লাগে- জানতে চাইলে সাখাওয়াৎ হোসেনের বাবা ফরিজ উদ্দিন বলেন, ‘আমার সব ছেলেমেয়ে মাস্টার্স পাস। শিক্ষকতা ছাড়াও অন্য চাকরি করার যোগ্যতা ছিল তাদের। কিন্তু আমি তাদের সব সময় শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত করতে উদ্বুদ্ধ করেছি। অন্য চাকরি করতে দিইনি। কারণ শিক্ষকরা সৎভাবে আয়ের পাশাপাশি জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে পারে।’

সাখাওয়াৎ হোসেন আরও বলেন, ‘ঈদ ও বিভিন্ন পারিবারিক অনুষ্ঠান ছাড়াও আমরা সবাই মাসে একবার হলেও বৈঠকে বসি। নিজেদের মধ্যে সমস্যা-সম্ভাবনা ও পাঠদান নিয়েও আলোচনা করি। শিক্ষক পরিবারের সবার একটাই কথা- আমরা শিক্ষক হয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্বপ্ন ছড়িতে দিতে পেরেছি- এটাই আমাদের বড় পাওয়া।’

ফুলছড়ি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আবদুল্লাহীশ শাফী জানান, ‘উপজেলার কঞ্চিপাড়া গ্রামে একই পরিবারের ২০ জন শিক্ষক থাকা আসলেই বিরল ঘটনা।’

ফুলছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুদুর রহমান মোল্লা বলেন, ‘একটি পরিবারে এত মেধাবী শিক্ষক রয়েছেন- এটা আশ্চর্যের বিষয়। সত্যিই জাতির জন্য একটি মহৎ কাজ করছে এ শিক্ষক পরিবার। তাদের এ আলোকিত শিক্ষকতা ছড়িয়ে পড়ূক দেশের সর্বত্র।’favicon59

Sharing is caring!

Leave a Comment